এক শতাব্দী ধরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে গঙ্গারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়
কালের সাক্ষী হয়ে নবগঙ্গা নদীর তীরে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক শতাব্দীরও বেশি প্রাচীন এক বিদ্যাপীঠ- গঙ্গারামপুর প্রসন্ন কুমার (পি.কে.) মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এটি শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়, এটি মাগুরার শালিখা উপজেলার হাজারো মানুষের স্বপ্ন পূরণের বাতিঘর, যেখান থেকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়েছেন অগণিত শিক্ষার্থী।
১৯০০ সাল। যখন এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, ঠিক তখনই কৃষক-শ্রমিক ও পিছিয়ে পড়া এক জনপদে শিক্ষার প্রদীপ জ্বালাতে এগিয়ে আসেন নড়াইলের কালিয়া নিবাসী, মাগুরার খ্যাতনামা আইনজীবী কামিনী কুমার সেন গুপ্ত। নিজের পিতার, অর্থাৎ যশোরের প্রখ্যাত আইনজীবী প্রসন্ন কুমার সেন গুপ্তের নামে তিনি এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
যাত্রার শুরুটা ছিল খুবই সাধারণ। খড়ের চালা আর টিনের বেড়ার ঘরে পাঠদান শুরু হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং স্থানীয় বিদ্যানুরাগীদের সহযোগিতায় খুব দ্রুতই প্রতিষ্ঠানটি আলোর মুখ দেখতে শুরু করে। এর সুফল মেলে মাত্র তিন বছরের মাথায়, যখন ১৯০৩ সালেই বিদ্যালয়টি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী স্বীকৃতি লাভ করে। প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে বঙ্কিম চন্দ্র দাসের হাত ধরে প্রতিষ্ঠানটির অগ্রযাত্রা শুরু হয়। সে সময় ১০-১২ কিলোমিটার দূর থেকেও শিক্ষার্থীরা পায়ে হেঁটে আসত জ্ঞানের সন্ধানে, যা শালিখা অঞ্চলের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এক নীরব বিপ্লব নিয়ে আসে।
বর্তমানে ৯ একর ১০ শতক জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৬৭৫ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কুমারেশ চন্দ্র দে বলেন, "এটি শুধু মাগুরা জেলার প্রাচীনতম বিদ্যালয়গুলোর একটি নয়, এটি আমাদের অঞ্চলের গৌরব। ২০১৮ সালে আমরা জাঁকজমকপূর্ণভাবে এর শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন করেছি। এই বিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী আজ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দেশের সেবায় নিয়োজিত আছেন, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের।"
শুধু কর্তৃপক্ষ নয়, এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে পেরে গর্বিত বর্তমান প্রজন্মও। তাদের চোখেমুখেও প্রিয় প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে দেখা যায় উচ্ছ্বাস।
নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রিয়া রানী বসু বলেন, "আমরা যখন শুনি আমাদের স্কুল একশ বছরেরও বেশি পুরনো, তখন এমনিতেই গর্বে বুক ভরে যায়। আমাদের শিক্ষকরা শুধু পড়াশোনাই করান না, তাঁরা আমাদের এই বিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতেও শেখান।"
ষষ্ঠ শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী সাঈফ আল জারিফ যোগ করে বলেন, "আমার বাবাও এই স্কুল থেকে পাস করেছেন। তাঁর কাছে স্কুলের অনেক গল্প শুনেছি। নবগঙ্গা নদীর তীরের এমন সুন্দর পরিবেশে পড়াশোনা করতে পারাটাও অনেক আনন্দের।"
শতাব্দী পেরিয়েও গঙ্গারামপুর প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয় তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এটি শালিখা উপজেলার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠ হিসেবে আজও নিরলসভাবে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে, হয়ে উঠেছে হাজারো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ গড়ার এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয়।
What's Your Reaction?
বিশ্বজিৎ সিংহ রায়, ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি, মাগুরাঃ