সত্য ধারণের ‘অপরাধে’ জীবন দিলেন সাংবাদিক তুহিন

সত্য প্রকাশের দুঃসাহসই কাল হলো তার। কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা নয়, নিছক একটি ভিডিও ডিলিট না করার অপরাধেই প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হলো সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ এক চাঞ্চল্যকর প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে, একটি ‘হানিট্র্যাপ’ (নারী সদস্য দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ) চক্রের নৃশংসতার দৃশ্য নিজের মোবাইল ফোনে ধারণ করায় এবং সেই ভিডিও মুছতে অস্বীকৃতি জানানোয় তুহিনকে জীবন দিতে হয়েছে।
শনিবার (৯ আগস্ট) নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার ড. নাজমুল করিম এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের মর্মান্তিক ও ভয়ংকর এই কাহিনী তুলে ধরেন। তিনি জানান, এই ঘটনায় জড়িত মূল হোতাসহ মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, ঘটনার সূত্রপাত হয় গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। বাদশা নামের এক ব্যক্তি একটি এটিএম বুথ থেকে ২৫ হাজার টাকা তোলার পর পারুল আক্তার ওরফে গোলাপী নামের এক নারী তাকে ‘হানিট্র্যাপ’-এর ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে। বিষয়টি বুঝতে পেরে বাদশা ওই নারীর সাথে বিতণ্ডায় জড়ালে পাশে ওঁৎ পেতে থাকা গোলাপীর সহযোগীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে বাদশার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
প্রাণে বাঁচতে রক্তাক্ত বাদশা যখন দৌড়ে পালাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিক তুহিন পুরো ঘটনাটি তার মোবাইল ফোনে ধারণ করছিলেন। বিষয়টি দেখে ফেলে সন্ত্রাসীরা। তারা তুহিনের পথ আটকে ভিডিওটি ডিলিট করার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু নির্ভীক তুহিন তাতে রাজি না হওয়ায় সন্ত্রাসীরা তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তুহিন আত্মরক্ষার্থে পাশের একটি মুদি দোকানে আশ্রয় নিলেও শেষ রক্ষা হয়নি। সেখানেই তাকে ঘিরে ধরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
এই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এবং অভিযান চালিয়ে মোট আটজনকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অন্যতম হোতা হলো ‘কেটু মিজান’, যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হলো ফয়সাল হাসান, শাহ জালাল, সুমন, মিজানের স্ত্রী গোলাপী, আল-আমিন এবং স্বাধীন। এরা সবাই একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী ও হানিট্র্যাপ চক্রের সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ।
জিএমপি কমিশনার ড. নাজমুল করিম বলেন, "এটি একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড যা হানিট্র্যাপকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। ভিডিও ডিলিট না করায় সন্ত্রাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে সাংবাদিক তুহিনকে হত্যা করে।" তিনি যথার্থ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারার দায় স্বীকার করে সাংবাদিক সমাজের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং নিহত তুহিনের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
এদিকে, গ্রেপ্তারকৃত সাতজনকে আদালতে তোলা হলে গাজীপুরের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রত্যেকের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। মামলার আরেক আসামি শহীদুল ইসলামকে কিশোরগঞ্জের ইটনা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এই ঘটনাটি একজন সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দেওয়ার এক করুণ উদাহরণ হয়ে রইলো, যা পুরো দেশকে নাড়া দিয়েছে।
What's Your Reaction?






