শিক্ষা ব্যবস্থায় বাসা বেঁধেছে ‘জাল সনদের ক্যানসার’: ফরিদপুর-গোপালগঞ্জসহ ৬ জেলায় ভয়াবহ জালিয়াতি ফাঁস

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
Dec 10, 2025 - 13:51
 0  42
শিক্ষা ব্যবস্থায় বাসা বেঁধেছে ‘জাল সনদের ক্যানসার’: ফরিদপুর-গোপালগঞ্জসহ ৬ জেলায় ভয়াবহ জালিয়াতি ফাঁস

মানুষ গড়ার কারিগররা যখন নিজেরাই জালিয়াতির আশ্রয় নেন, তখন জাতির মেরুদণ্ড নড়বড়ে হতে বাধ্য। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমনই এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া কিছু নথিপত্রে। ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী ও মাদারীপুর—এই ৬ জেলায় জাল সনদ দিয়ে এমপিও ভুক্ত হয়েছে শতাধিক শিক্ষক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এসব তালিকা নিয়ে এখন তোলপাড় চলছে স্থানীয় শিক্ষা মহলে।

ফাঁস হওয়া তথ্যে যা আছে:
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (DIA) এবং এনটিআরসিএ-এর বিভিন্ন সময়ের তদন্ত রিপোর্টের আদলে তৈরি এসব তালিকায় দেখা যায়, অভিযুক্ত শিক্ষকরা ভুয়া ইনডেক্স এবং জাল সনদ ব্যবহার করে বছরের পর বছর ধরে সরকারি বেতন-ভাতা ভোগ করছেন। নথিতে লাল কালিতে তাদের সনদের পাশে ‘জাল/ভুয়া’ মন্তব্য করা হয়েছে।

জেলার চিত্র: গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর শীর্ষে
ভাইরাল হওয়া তথ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম দেখা গেছে গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলায়। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার হাদিউজ্জামান মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর (কম্পিউটার) মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের (ইনডেক্স- ১০০০০০২৫) সনদটি নথিতে ‘জাল’ হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়া কাশিয়ানীর আলহাজ্ব এ. জি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শাহনাজ পারভীন এবং সদর উপজেলার চন্দ্র দিঘলীয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের কল্পনা রানী শিবালীর নামও রয়েছে এই তালিকায়।

অন্যদিকে, ফরিদপুর জেলার একটি দীর্ঘ তালিকা ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সালথা কলেজ, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় এবং সিরাজাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নাম রয়েছে সেখানে। অভিযুক্তদের ওই তালিকায় নগরকান্দার সালথা কলেজের শরীরচর্চা বিষয়ক সহকারী শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস, বোয়ালমারীর হামিদ্দীয়া ইউনাইটেড উচ্চ বিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক নারায়ন চন্দ্র সাহা এবং সদর উপজেলার বাখুন্ডা উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃষি শিক্ষিকা আকলিমা খানম রনির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ফরিদপুর মহাবিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনার প্রভাষক নরেশ চন্দ্র মন্ডল, মধুখালী মহিলা ডিগ্রী কলেজের ইসলামের ইতিহাসের প্রভাষক মোঃ আবুল হাসান মিয়া, নগরকান্দার এম.এন. একাডেমির জেসমিন খানম, সদরের আলহাজ্ব এম. এ. আজিজ হাই স্কুলের মোঃ জাকির হোসেন, ফুলবাড়ীয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের গীতা বিশ্বাস, চরভদ্রাসনের হরিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মোঃ সোহেল রানা এবং চাদঁহাট বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের কম্পিউটার শিক্ষক কামরুন নাহারের নামও রয়েছে। অনেক শিক্ষকের নামের পাশে ‘এমপিও স্থগিত’ বা বেতন কোড ‘০০’ উল্লেখ থাকায় তাদের সনদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

নামি প্রতিষ্ঠানও তালিকার বাইরে নয়:
জালিয়াতির এই সিন্ডিকেট থেকে বাদ যায়নি গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোও। গাজীপুরের টঙ্গীর ‘সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতন এন্ড কলেজ’-এর প্রভাষক মোছাঃ জান্নাতুল ফেরদৌস এবং টাঙ্গাইলের গোপালপুরের ‘মেহের-নেছা মহিলা কলেজ’-এর প্রভাষক মুক্তা রাণী দে-র নামও ভুয়া সনদধারীদের তালিকায় উঠে এসেছে।

জনমনে তীব্র ক্ষোভ:
বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর অভিভাবক ও স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। ফরিদপুরের সচেতন নাগরিক রবিউল হাসান রাজিব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “ফরিদপুর জেলার স্বনামধন্য জাল সার্টিফিকেটে চাকরিরত স্যারদের তালিকা। এদের কাছে থেকে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে? যেখানে এরাই বড় চোর!”

কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ:
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই তালিকাগুলো যদি সঠিক হয়, তবে তা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত। অবিলম্বে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে এসব সনদের সত্যতা যাচাই করার দাবি উঠেছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি এতদিন উত্তোলিত সরকারি অর্থ ফেরত এবং তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow