একটি সেতুর অভাবে থমকে আছে ৩ লাখ মানুষের স্বপ্ন

বর্ষায় উত্তাল নদী, শুকনায় নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো। যুগ যুগ ধরে এভাবেই জীবন বাজি রেখে কুমার নদ পার হচ্ছেন ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের সীমান্তবর্তী তিন লাখেরও বেশি মানুষ। ফরিদপুরের নগরকান্দা ও সালথা উপজেলার সংযোগস্থলে কামারদিয়া ঘাট পয়েন্টে একটি সেতুর অভাব যেন এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যকে স্থবির করে দিয়েছে। একটি মাত্র সেতু বদলে দিতে পারে তাদের কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর সামাজিক জীবনের পুরো চিত্র, কিন্তু সেই স্বপ্ন আজও রয়ে গেছে অধরা।
এই দুর্ভোগের চিত্রটি বহুমাত্রিক এবং ভয়াবহ। সবচেয়ে মর্মান্তিক পরিস্থিতি তৈরি হয় কোনো রোগী অসুস্থ হলে। জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়াটা এখানে রীতিমতো এক যুদ্ধ; নদী পার হতে হতেই ঝরে যায় অনেক মুমূর্ষু রোগীর প্রাণ। একইভাবে, পরিবহন সংকটের কারণে হাজার হাজার কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নদী পারাপারের ভোগান্তিতে হয় তাদের কষ্টের ফসল নষ্ট হয়, নয়তো কম দামে স্থানীয় ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন।
এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের জীবনও অনিশ্চয়তায় ভরা। কামারদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র রবিউল ইসলামের কথায় ফুটে ওঠে সেই আর্তি, "বর্ষায় নৌকা না পেলে বা আবহাওয়া খারাপ থাকলে আমাদের স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে অপেক্ষা করতে হয়।" জীবনের ঝুঁকি ভেবে অনেক অভিভাবকই তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পান। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা এতটাই প্রকট যে, এই অঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের ভালো ঘরে বিয়ে পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
খেয়াঘাটের মাঝি জমির মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, "ঝড়-বৃষ্টি বা সামান্য বাতাসেই নৌকা চালানো বন্ধ রাখতে হয়। আবার কচুরিপানার কারণেও ঘাট বন্ধ থাকে। সবখানে ব্রিজ হয়ে গেল, শুধু এখানেই হলো না। একটা ব্রিজ হলে হাজার হাজার মানুষ বেঁচে যেত।"
এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের এই দাবি নিয়ে কথা বলেন বল্লভদী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খন্দকার সাইফুর রহমান শাহিন। তিনি বলেন, "এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। অথচ পাশের কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখানে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সালথা উপজেলা প্রকৌশলী মো. জাফর মিয়া বলেন, "ওই স্থানে আইডিভুক্ত রাস্তা নেই। তারপরও আমি একজন প্রকৌশলীকে সরেজমিনে পরিদর্শনের জন্য পাঠাব এবং পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
একটি সেতুর অভাবে একটি অঞ্চলের অর্থনীতি, শিক্ষা ও সামাজিক ব্যবস্থা কীভাবে পিছিয়ে পড়তে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ কামারদিয়া এলাকা। প্রশাসনের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপে বদলে যেতে পারে লাখো মানুষের ভাগ্য, পূরণ হতে পারে তাদের যুগ যুগের স্বপ্ন। এখন শুধু প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় ভুক্তভোগী মানুষ।
What's Your Reaction?






