ফসলি জমি গিলে খাচ্ছে মাছের ঘের: মাদারীপুরে কৃষকের স্বপ্ন বাঁচাতে ১৪৪ ধারা

আলমাস বেপারী, কালকিনি প্রতিনিধি, মাদারীপুরঃ
Aug 22, 2025 - 23:29
 0  7
ফসলি জমি গিলে খাচ্ছে মাছের ঘের: মাদারীপুরে কৃষকের স্বপ্ন বাঁচাতে ১৪৪ ধারা

যেখানে সোনালি ধানের শীষ বাতাসে দোলার কথা, সেখানে এখন ঘুরছে মাটি কাটার যন্ত্র ভেকুর চাকা। শত শত কৃষকের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন উর্বর ফসলি জমি জোরপূর্বক দখল করে মাছের ঘের নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। কৃষকের স্বপ্ন আর মাটির অধিকার রক্ষায় শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেছে আদালত, জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। এ ঘটনায় এলাকাজুড়ে বিরাজ করছে তীব্র উত্তেজনা ও চাপা ক্ষোভ।

ডাসার ইউনিয়নের গোপালসেন, কালাইতলা ও জীনবাড়ি মৌজার প্রায় ৮০ একর জমিই এলাকার কয়েকশ' কৃষকের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মূল ভিত্তি। বংশ পরম্পরায় এই জমিতে ধান চাষ করেই তাদের সংসার চলে। কিন্তু সম্প্রতি এই জমিতে নজর পড়েছে ডাসার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম ভাষাই শিকদারের। কৃষকদের অভিযোগ, তিনি কিছু জমি ভাড়া নেওয়ার কথা বলে ভেকু মেশিন দিয়ে নির্বিচারে মাটি কেটে বিশাল এলাকাজুড়ে মাছের ঘের নির্মাণ শুরু করেছেন।

ভুক্তভোগী কৃষক হানিফ মোল্লা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার জমিতে চেয়ারম্যান জোর করে ঘের বানাতে চাইছেন। এই জমিটুকু না থাকলে আমাদের ফসল ফলানো বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আমি ও আমার পরিবার না খেয়ে মরবো।” আরেক স্থানীয় বাসিন্দা শাহীন মাতুব্বর বলেন, “আমার বাবা ২৫ বছর ধরে এই জমিতে ধান চাষ করেছেন। এখন আমরাও সেই চাষাবাদ করে জীবিকা চালাই। চেয়ারম্যান মাছের ঘের করলে আমাদের পুরো পরিবারের পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।” শুধু জীবিকা নয়, পরিবেশ নিয়েও উদ্বিগ্ন এলাকাবাসী। সুজন মাতুব্বর নামে এক যুবক বলেন, “এখানে মাছের ঘের হলে এলাকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা চাই না আমাদের সবুজ গ্রামটা নষ্ট হোক। প্রশাসনের কাছে আমাদের আকুল আবেদন, দ্রুত একটি কার্যকর ব্যবস্থা নিন।”

বিষয়টি নিয়ে কৃষকরা একজোট হয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের দ্বারস্থ হন। অভিযোগ পেয়ে ডাসার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস তার তদন্ত প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন, প্রায় ৩৫-৪০ একর জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে মৎস্য খামার বানানো হলে ওই এলাকার ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ফসলি জমি নষ্ট করে মাছের ঘের নির্মাণের জন্য জমির শ্রেণি পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাটি কাটা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলেও তা মানেননি অভিযুক্ত চেয়ারম্যান। উপায় না দেখে ভুক্তভোগী কৃষক হানিফ মোল্লা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এরপর গত ১৮ আগস্ট আদালত শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় ওই জমিতে ১৪৪ ধারা জারি করেন এবং ডাসার থানাকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেন। একইসাথে, উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) বিষয়টি তদন্ত করে আগামী ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অভিযুক্ত চেয়ারম্যান রেজাউল করিম ভাষাই শিকদার তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি কয়েকজন কৃষকের কাছ থেকে বৈধভাবে জমি ভাড়া (লিজ) নিয়েছি। ওই জমিগুলোতে তেমন ফসল হয় না। কৃষকদের মতামত নিয়েই আমি ঘের নির্মাণের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু একটি মহল আমাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে।”

ডাসার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সুবির চন্দ্র সূত্রধর জানান, “আদালতের নির্দেশে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ১৪৪ ধারার নোটিশ জারি করেছি। উভয় পক্ষকেই আইন মেনে চলার জন্য কঠোরভাবে বলা হয়েছে।”

ডাসার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) সাইফ-উল-আরেফীন বলেন, “আইন অনুযায়ী ফসলি জমিতে মাছের ঘের নির্মাণের কোনো বিধান নেই। কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা আমাদের প্রথম দায়িত্ব। আমরা কৃষি কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়েছি এবং প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

আপাতত ভেকুর গর্জন থেমেছে, তবে কৃষকদের বুকের ভেতর উদ্বেগ কমেনি। এখন সকলের চোখ আদালতের পরবর্তী নির্দেশ এবং প্রশাসনের চূড়ান্ত পদক্ষেপের দিকে। উর্বর ফসলি জমি কি তার আগের রূপে ফিরবে, নাকি মাছের ঘেরের অতল জলে হারিয়ে যাবে শত শত কৃষকের স্বপ্ন? উত্তর মিলবে ২৩ সেপ্টেম্বরের পরই।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow