সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে দুই শিক্ষকের লাগামহীন দুর্নীতি

কবির হোসেন, আলফাডাঙ্গা প্রতিনিধি, ফরিদপুরঃ
Oct 26, 2025 - 14:07
 0  28
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে দুই শিক্ষকের লাগামহীন দুর্নীতি

যেখানে থাকার কথা শিশুদের কলরব আর জ্ঞানার্জনের প্রাণচাঞ্চল্য, সেখানে অফিস কক্ষেই চলে রান্নার আয়োজন। শিক্ষকের বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষে ঘুমিয়ে থাকার অভিযোগ, আর সরকারি অনুদানের টাকা নয়ছয় হয়ে পরিণত হয়েছে কাগজে-কলমের হিসাবে। এটি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার নওয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র, যা এলাকাবাসী ও অভিভাবকদের চোখে এখন অনিয়মের এক মহোৎসবে পরিণত হয়েছে।

এই সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি যেন পরিণত হয়েছে এর প্রধান শিক্ষক ও একজন প্রভাবশালী সহকারী শিক্ষকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে। তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো গুরুতর অভিযোগ তুলে ফুঁসে উঠেছেন স্থানীয়রা। দীর্ঘদিন ধরে একই বিদ্যালয়ে কর্মরত থেকে তারা শিক্ষা ব্যবস্থাকে জিম্মি করে ফেলেছেন বলে অভিযোগকারীদের দাবি। এই ঘটনায় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মফিদুল ইসলাম তালুকদার এবং সহকারী শিক্ষক এনামুল হকের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে একাধিক গুরুতর অভিযোগ তোলা হয়েছে। অভিযোগকারীদের মতে, এই দুই শিক্ষকের কর্মকাণ্ডে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।

একাধিক সূত্র এবং স্থানীয়দের অভিযোগ অনুযায়ী, প্রধান শিক্ষক মফিদুল ইসলাম তালুকদারের বিরুদ্ধে দায়িত্বে চরম অবহেলা এবং বিদ্যালয়কে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে, তিনি বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষকে কার্যত রান্নাঘরে পরিণত করেছেন এবং ক্লাস চলাকালীন সেখানেই রান্না করা হয়, যা পাঠদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।

অন্যদিকে, সহকারী শিক্ষক এনামুল হকের বিরুদ্ধে নিয়মিত দেরিতে বিদ্যালয়ে আসা এবং নানা অজুহাতে ব্যক্তিগত কাজে বাইরে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। একজন অভিভাবকের অভিযোগ, তিনি নিজের সন্তানকে অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি করালেও তাকে নওয়াপাড়া বিদ্যালয়ে এনে নিজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পড়ান। এছাড়া তার বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষে ঘুমানো এবং মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকার মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে।

গ্রামবাসীদের আরও অভিযোগ, বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক সংস্কার, ক্ষুদ্র মেরামতসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কাগজে-কলমে প্রকল্পের ব্যয় দেখানো হলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই বলে তারা দাবি করেন।

স্থানীয়রা জানান, প্রধান শিক্ষক মফিদুল ইসলাম গ্রামের বাসিন্দা এবং সহকারী শিক্ষক এনামুল হক স্থানীয় পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতির পুত্র হওয়ায় তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। এই সুযোগে তারা বিদ্যালয়ের সরকারি জায়গা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করছেন এবং বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুমতি ছাড়াই স্থাপনা নির্মাণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সহকারী শিক্ষক এনামুল হক জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও বিদ্যালয়ের স্লিপ কমিটির দায়িত্বে রয়েছেন এবং প্রধান শিক্ষকের সাথে যোগসাজশে সরকারি বরাদ্দ আত্মসাৎ করছেন বলে অভিযোগকারীরা দাবি করেছেন।

একজন নারী অভিভাবক রাজিয়া সুলতানা বলেন, "বিদ্যালয়ের পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। শিক্ষকরা সময়মতো আসেন না, ঠিকমতো পড়ানও না। আমরা প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ চাই।" আরেক গ্রামবাসী মাহমুদ মিয়া জানান, তিনি বিষয়টি নিয়ে লিখিতভাবে প্রশাসনকে জানিয়েছেন। অভিভাবক শামীম মিয়ার মতে, বিদ্যালয়টি এখন কয়েকজনের পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে, যার ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী শিক্ষক এনামুল হক সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, "যাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে, তারাই এসব অভিযোগ করছে।" প্রধান শিক্ষক মো. মফিদুল ইসলাম তালুকদারও অভিযোগগুলোকে "সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত" বলে আখ্যা দিয়েছেন।

আলফাডাঙ্গা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামসের উদ্দিন টিটো বলেন, "অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, কারণ দায়িত্বে অবহেলাকারী শিক্ষকরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেন।"

এ বিষয়ে আলফাডাঙ্গা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। তিনি বলেন, "লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"

এলাকাবাসী ও অভিভাবকরা বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে অভিযুক্ত শিক্ষকদের দ্রুত বদলি এবং তদন্তের মাধ্যমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow