মস্কোর নির্বাসনে ‘ডাক্তার’ আসাদ: স্বৈরশাসনের পর চক্ষুবিদ্যায় ফেরার চেষ্টা

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
Dec 17, 2025 - 16:24
 0  5
মস্কোর নির্বাসনে ‘ডাক্তার’ আসাদ: স্বৈরশাসনের পর চক্ষুবিদ্যায় ফেরার চেষ্টা
ছবি : সংগৃহীত

২০১১ সালের দিকে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের একটি স্কুল মাঠের দেয়ালে স্প্রে করে লেখা হয়েছিল—‘এবার আপনার পালা, ডাক্তার’। আরব বসন্তের উত্তাল সময়ে এই গ্রাফিতি ছিল তৎকালীন সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সতর্কবার্তা। লন্ডনে চক্ষুবিজ্ঞানে পড়াশোনা করা এই ‘ডাক্তার’-ই যে পরবর্তী স্বৈরশাসক হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন—সে ইঙ্গিতই ছিল সেখানে। তবে সেই ভবিষ্যদ্বাণি বাস্তবে রূপ নিতে সময় লেগেছে দীর্ঘ ১৪ বছর।

এই সময়ের মধ্যে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে প্রাণ গেছে অন্তত ৬ লাখ ২০ হাজার মানুষের, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহী বাহিনীর অগ্রগতির মুখে সন্তানদের নিয়ে রাতের আঁধারে দামেস্ক ছেড়ে পালিয়ে রাশিয়ার মস্কোয় আশ্রয় নেন বাশার আল–আসাদ।

ক্ষমতা হারানোর এক বছর পর এখন মস্কোয় বিলাসবহুল নির্বাসিত জীবনে দিন কাটাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের শেষ বাথপন্থী শাসনের এই নেতা। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রের দাবি, নিজের স্বৈরশাসনের অধ্যায় পেছনে ফেলে বাশার আল–আসাদ আবারও তাঁর পুরোনো পেশা—চক্ষুবিদ্যায় ফিরতে আগ্রহী হয়েছেন। মস্কোয় বসেই তিনি চক্ষুবিজ্ঞানের পড়াশোনা ঝালিয়ে নিচ্ছেন এবং একই সঙ্গে রুশ ভাষা শিখছেন।

আসাদ পরিবারের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানান, “চক্ষুবিদ্যা বাশারের পছন্দের বিষয়। প্রেসিডেন্ট থাকাকালেও যুদ্ধ শুরুর আগে তিনি দামেস্কে নিয়মিত রোগী দেখতেন। তাঁর অর্থের কোনো অভাব নেই।” ইঙ্গিত মিলছে, মস্কোর অভিজাত সমাজের কেউ কেউ ভবিষ্যতে তাঁর রোগীও হতে পারেন।

রুবলিওভকায় বিলাসী কিন্তু বিচ্ছিন্ন জীবন

সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আসাদ পরিবার বর্তমানে মস্কোর অভিজাত রুবলিওভকা এলাকায় বসবাস করছে—যেখানে ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের মতো ক্ষমতাচ্যুত নেতারাও আশ্রয় নিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। তবে আরামদায়ক জীবনযাপনের পরও সিরীয় ও রুশ অভিজাত সমাজ থেকে পরিবারটি কার্যত বিচ্ছিন্ন।

২০১১ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে কঠোর দমন–পীড়নের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় সিরিয়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বড় অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ওই সময় থেকেই আসাদ পরিবার তাদের উল্লেখযোগ্য সম্পদ মস্কোয় স্থানান্তর করে, যা পশ্চিমাদের নাগালের বাইরে ছিল।

তবে সিরিয়া থেকে শেষ মুহূর্তে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় বাশারের অনুগামীদের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। রুশ কর্তৃপক্ষও তাঁকে সিরিয়ার সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগে নিরুৎসাহিত করছে।

ক্রেমলিনে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ আসাদ

ক্রেমলিনের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও রাজনৈতিক অভিজাতদের কাছে বাশার আল–আসাদ এখন ‘অপ্রাসঙ্গিক’। ক্ষমতাচ্যুত নেতাদের প্রতি পুতিনের আগ্রহ কম—এ কারণে নৈশভোজ বা সামাজিক অনুষ্ঠানেও আসাদ আর আমন্ত্রিত অতিথি নন।

দামেস্ক ছাড়ার সময় বাশার তাঁর পরিবারের বৃহৎ অংশ বা সরকারের ঘনিষ্ঠদের আগাম কোনো সতর্কবার্তা দেননি। প্রথম কয়েক মাস তিনি মূলত স্ত্রী আসমা আল–আসাদের চিকিৎসা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন লিউকেমিয়ায় ভোগা আসমা মস্কোয় চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র।

জনসমক্ষে আসতে নিষেধাজ্ঞা

স্বাস্থ্য পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার পর বাশার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। রুশ সংবাদমাধ্যম আরটি ও একজন মার্কিন ডানপন্থী পডকাস্টারকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার কথাও শোনা গেছে। তবে রুশ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না পাওয়ায় তিনি এখনও প্রকাশ্যে আসতে পারেননি। নভেম্বরে ইরাকি গণমাধ্যমে তাঁর জীবনযাপন নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত নিশ্চিত করেন, আসাদকে প্রকাশ্য কার্যক্রমে অংশ নিতে নিষেধ করা হয়েছে।

সন্তানদের নতুন জীবন

তুলনামূলকভাবে বাশারের সন্তানরা মস্কোর অভিজাত জীবনে দ্রুত মানিয়ে নিচ্ছেন। গত ৩০ জুন একমাত্র জনসমক্ষে পরিবারটিকে একসঙ্গে দেখা যায়—মেয়ে জেইন আল–আসাদের স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠানে। তিনি মস্কোর অভিজাত এমজিআইএমও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন।

একসময় সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে আলোচিত ছেলে হাফেজ আল–আসাদ এখন লোকচক্ষুর অন্তরালে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বেশির ভাগ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে তিনি ছদ্মনামে নতুন অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছেন বলে জানা গেছে।

পরিবারটির এক বন্ধু বলেন, “তারা এখনো মানসিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সিরিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে না থাকার বাস্তবতায় মানিয়ে নিতে সময় লাগছে।”

সংযুক্ত আরব আমিরাত ছিল একসময় আসাদ পরিবারের প্রিয় গন্তব্য। এখনও সন্তানরা নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করেন। তবে পরিবারটি বুঝতে পারছে, স্থায়ীভাবে রাশিয়া ছাড়াও সহজ নয়। কারণ, ইউএই-ও এখন আর এই পরিবারকে আগের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে আতিথ্য দিতে আগ্রহী নয়।

এক সময় শক্ত হাতে সিরিয়া শাসন করা বাশার আল–আসাদ আজ মস্কোর বিলাসবহুল প্রাসাদে নিরিবিলি জীবনে সীমাবদ্ধ—যেখানে রাজনীতি নয়, চক্ষুবিদ্যার পাঠই যেন তাঁর নতুন বাস্তবতা।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow