থানচিতে দুর্দশাগ্রস্ত নারীদের সঞ্চয় ফেরত না পাওয়ায় গভীর হতাশা
বান্দরবানের থানচি উপজেলার চার ইউনিয়নের প্রায় ১ হাজার ৬৭৪ দুস্থ নারী উপকারভোগী ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (ভিডব্লিউবি) ও ভিজিডি কর্মসূচির সঞ্চয়ী টাকার জন্য চরম হতাশা, মানসিক চাপ ও মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। এক বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এই সঞ্চয় ফেরত দেওয়া হয়নি। বরং পরিবহন খরচের নামে অতিরিক্ত ৫০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সঞ্চয় সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকে না রাখার অভিযোগ
উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৪ সাল থেকে ভিডব্লিউবি–ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় চার ইউনিয়নের ১ হাজার ৬৭৪ পরিবারকে মাসিক ৩০ কেজি করে পুষ্টি খাদ্য চাল এবং সুরক্ষা সঞ্চয় হিসেবে শুরুতে মাসে ২০০ টাকা, পরে ২২০ টাকা নেওয়া হয়। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী এই সঞ্চয় তহবিল উপজেলা কমিটির সভাপতি–সচিবের যৌথ স্বাক্ষরে অনুমোদিত ব্যাংকে জমা রাখার কথা। কিন্তু থানচির চার ইউনিয়নে সেই নিয়ম মানা হয়নি।
অভিযোগ উঠেছে, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আয়েশা বেগমের পরামর্শে সঞ্চয়ের টাকা স্থানীয়ভাবে ‘ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে’ ব্যবহৃত হয়েছে। মেয়াদ শেষে অন্যের কাছ থেকে ধার করে সঞ্চয় ফেরত দেওয়ার অনিয়মিত প্রচলনের কারণে উপকারভোগীরা এখন তাদের টাকা ফেরত পাবেন কি না—এ নিয়ে গভীর শঙ্কায় রয়েছেন।
রহস্যজনক মৃত্যুর পরে আরও জটিলতা
বলিপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াঅং মারমা জানান, তাঁর ইউনিয়নের ৩৫০ জন উপকারভোগীর দুই বছরের ১৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করে উপজেলা কর্মকর্তা এমরান হোসেনের হাতে দিয়েছেন। কিন্তু নগদ লেনদেনের কোনো রসিদ বা নথি রাখা হয়নি।
গত ২০ সেপ্টেম্বর এমরান হোসেন স্ট্রোকে মারা যাওয়ার পর পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। তাঁর স্ত্রী রুমা আক্তার জানান, বাজারদরের তুলনায় কম দেখিয়ে তাঁকে মাত্র ৮ লাখ টাকার নথিপত্র দেখানো হয়েছে। পেনশন স্কিমের টাকা পাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন কাগজে তাঁর স্বাক্ষরও নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
উপকারভোগীদের হতাশা
বিভিন্ন ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, ভিজিডি কার্ডধারী পরিবারের নারীরা দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।
নুমেউ মারমা, উমেসিং মারমা, মাচাইসিং মারমা ও হ্লায়ইনু মারমা জানান, ২০২৩–২৪ চক্রে তাঁরা মাসে ৩০ কেজি করে চাল পেয়েছেন এবং প্রতি মাসে ২৭০ টাকা করে সঞ্চয় দিয়েছেন। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সেই সঞ্চয় সুদসহ ফেরত পাওয়ার কথা থাকলেও ডিসেম্বর পর্যন্ত কিছুই পাননি।
তাদের ভাষায়, “এই টাকা পেলে হাঁস–মুরগি কিনে পরিবার নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন আমরা দিশাহারা।”
তিন্দু ও রেমাক্রী ইউনিয়নের নারীরাও একই অভিযোগ জানান—চেয়ারম্যানরা বারবার সময় দিতে দিতে এক বছর পার করে দিয়েছেন।
সঞ্চয় ব্যাংকে নেই—স্বীকার করলেন ব্যাংককর্তারা
স্থানীয় সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ভিডব্লিউবি–ভিজিডি কর্মসূচির কোনো সঞ্চয় তহবিল তাঁদের ব্যাংকে কিংবা ইন্ডোভিজুয়াল এনবিএফআই একাউন্টে জমা নেই।
ডিজিটাল আউটসোর্সিং কর্মী চয়নয় মারমা বলেন, ২০২১–২২ চক্রে উপকারভোগীদের সঞ্চয়ের হিসাব ব্যাংক এশিয়ার ইন্ডোভিজুয়াল অ্যাকাউন্টে ছিল। পরে চেয়ারম্যানদের লোভে এই পদ্ধতি বন্ধ হয়ে যায়।
দায় স্বীকার ও পাল্টা অভিযোগ
বলিপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াঅং মারমা স্বীকার করেন যে ২৭০ টাকার সঙ্গে ৫০ টাকা করে পরিবহন খরচ রাখা হয়। তিনি আরও জানান, ওই টাকা থেকে স্থানীয় একজন প্রতিবেদককে মাসে ১ হাজার টাকা ও ৩০ কেজি চাল দিতে হয়েছে, না দিলে তিনি সংবাদ প্রকাশের হুমকি দিতেন।
তিন্দু ইউপি চেয়ারম্যান ভাগ্য চন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, “আমরা পুরোনো অভিজ্ঞ চেয়ারম্যান ও মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার গুটি চালের শিকার হয়েছি। দ্রুত টাকা ফেরত দেবো।”
রেমাক্রী ইউপি চেয়ারম্যান মুইশৈথুই মারমা রনি ফোনে বলেন, বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে চান না এবং সংবাদ না করার হুমকি দিয়ে ফোন কেটে দেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য
মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আয়েশা আক্তার বলেন, দুই উপজেলার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। এমরান হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে সঞ্চয় ফেরত দিতে বিলম্ব হয়েছে। তিনি ১ জানুয়ারি ২০২৬-এর মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ–আল ফয়সাল জানান, “১ জানুয়ারি থেকে উপকারভোগীদের সঞ্চয় ফেরত দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আমি উপস্থিত থেকে বিতরণ নিশ্চিত করব।”
মানুষের আস্থা সংকট
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা ক্যসাউ মারমা বলেন, “দুস্থ নারীর সঞ্চয়ের টাকা লুণ্ঠন হলে ভবিষ্যতে কেউই সরকারি প্রকল্পে আস্থা রাখবে না।”
থানচির অতি দরিদ্র নারীদের সঞ্চয় বিতরণে অনিয়ম ও জটিলতা দূর না হলে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা আরও বাড়বে—এমনই আশঙ্কা সাধারণ মানুষের।
What's Your Reaction?
অনুপম মারমা, থানচি প্রতিনিধি, বান্দরবানঃ