তুলসী: ঘরোয়া চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ‘অমৃত ভেষজ’
বাঙালির আঙিনা, বাড়ির উঠান কিংবা মাটির টবে—তুলসী গাছ বহু যুগ ধরে ঘরের এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান। ধর্মীয় বিশ্বাস, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও ঘরোয়া ব্যবহারে এর মূল্য অপরিসীম। সহজে চাষযোগ্য এই গাছ দুর্গন্ধনাশক, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তুলসীর ভেষজ গুণ আজ স্বীকৃত।
তুলসীর জাতভেদে রং ও গঠনে কিছু পার্থক্য রয়েছে। সাধারণত দুটি জাত সবচেয়ে পরিচিত—একটি উজ্জ্বল সবুজ পাতা ও কোমল সবুজ ডাঁটার, অন্যটি বেগুনি বা কালচে পাতার যার ডাঁটাও বেগুনি রঙের। ঔষধি গুণের কারণে বেগুনি তুলসী অনেকের কাছে বেশি জনপ্রিয়। উভয় ধরনের তুলসীই সাধারণত ১ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয় এবং পাতার সুগন্ধী তেলই এই গাছের মূল ভেষজ উপাদান হিসেবে কাজ করে।
শ্বাসকষ্ট, সর্দি, কাশি, ফ্লু, অ্যাজমা বা ব্রঙ্কাইটিসের ঘরোয়া চিকিৎসায় তুলসী বহু যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পাতার রস শ্বাসনালি পরিষ্কার রাখে এবং কফ কমায়। তুলসীতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও এসেনশিয়াল অয়েল দেহের রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়িয়ে শরীরকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। নিয়মিত তুলসী পাতা খেলে সর্দি-কাশির ঝুঁকি কমে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
হজম সমস্যায় তুলসী একটি প্রাকৃতিক প্রতিষেধক। অম্বল, গ্যাস ও অজীর্ণতা দূর করতে সকালে ৪–৫টি তুলসী পাতা খাওয়া উপকারী। পাশাপাশি তুলসীর সুগন্ধ স্নায়ুকে শান্ত করে, ক্লান্তি কমায় এবং মানসিক অস্থিরতা দূর করতে সহায়তা করে। ফলে এটি প্রাকৃতিক স্ট্রেস–রিলিভার হিসেবেও পরিচিত।
তুলসীর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ ত্বকে ব্রণ প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। চুলের খুশকি, সংক্রমণ ও চুল পড়া কমাতে তুলসীযুক্ত তেল ও হেয়ার মাস্ক ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে তুলসীর ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, কারণ এটি শরীরের গ্লুকোজ বিপাককে উন্নত করতে পারে।
তুলসী এখন নানা ঘরোয়া পণ্য ও ভেষজ প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। তুলসী চা, হারবাল ড্রিঙ্ক, কফ সিরাপ, তুলসী তেল, ফেসওয়াশ, প্যাক, ক্রিম, চুলের তেল, হারবাল শ্যাম্পু, অ্যারোমা সলিউশন, ধূপ, এসেনশিয়াল অয়েল, ডিটক্স ওয়াটারসহ বিভিন্ন পণ্যে এটি ব্যবহৃত হয়। বিদেশি রান্না যেমন সালাদ, পাস্তা ও স্যুপেও ‘বেসিল’ নামে তুলসীর ব্যবহার দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।
তুলসী গাছ বাতাসের জীবাণুনাশক ক্ষমতা বাড়ায়, পরিবেশকে সুগন্ধী রাখে এবং মশা-পোকামাকড় দূর করে। ধর্মীয় বিশ্বাসে তুলসীকে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, যা ঘরের পরিবেশে শান্তি আনে বলে অনেকের ধারণা।
অত্যন্ত সাধারণ হলেও অমূল্য—তুলসীর গুণাগুণ যেন শেষ করার মতো নয়। প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রে যার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, আধুনিক বিজ্ঞানও আজ সেই মূল্যকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, রান্না কিংবা পরিবেশ—সব ক্ষেত্রেই তুলসীর উপস্থিতি অনন্য। একটি বাড়ির কোণায় একটি তুলসী গাছ থাকলেই সেটিই হতে পারে পুরো পরিবারের প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যরক্ষাকারী।
What's Your Reaction?
বিশ্বজিৎ সিংহ রায়, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি