খাগড়াছড়িতে অনির্দিষ্টকালের সড়ক অবরোধ : ১৪৪ ধারার মধ্যেই গুইমারায় হামলা

মোহাম্মদ কেফায়েত উল্লাহ, জেলা প্রতিনিধি, খাগড়াছড়িঃ
Sep 28, 2025 - 20:38
 0  6
খাগড়াছড়িতে অনির্দিষ্টকালের সড়ক অবরোধ : ১৪৪ ধারার মধ্যেই গুইমারায় হামলা

অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি। এ ঘটনার প্রতিবাদে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ডাকে চলমান অনির্দিষ্টকালের সড়ক অবরোধ কর্মসূচিতে জেলাজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ, হামলা, অগ্নিসংযোগ ও গোলাগুলির ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩ জন নিহত এবং সেনাবাহিনীর সদস্যসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, যাদের কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জেলা প্রশাসন অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করলেও উত্তেজনা কমেনি। জেলার সর্বত্র থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং দূরপাল্লার সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

সম্প্রতি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার সিঙ্গিনালা এলাকায় অষ্টম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ভুক্তভোগীর পরিবারের অভিযোগের পর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পুলিশ প্রধান অভিযুক্ত শয়ন শীলসহ মোট তিনজনকে গ্রেফতার করে।

এই ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে একটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার অর্ধদিবস সড়ক অবরোধ এবং শুক্রবার প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়।

শুক্রবার অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে একদল উশৃঙ্খল জনতা সেনাবাহিনীর গাড়িতে হামলা চালায় এবং কয়েকজন সেনাসদস্যকে আহত করে। এসময় তারা ‘পাহাড় থেকে সেনা হটাও’ স্লোগান দেয়। ওই সমাবেশ থেকেই শনিবার পূর্ণদিবস সড়ক অবরোধের ঘোষণা দেওয়া হয়।

অভিযোগ রয়েছে, শনিবার অবরোধ চলাকালে কতিপয় পাহাড়ি দুর্বৃত্ত কয়েকটি মসজিদে হামলা, অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর এবং বাঙালিদের দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করে। এর প্রতিবাদে স্থানীয় বাঙালিরা রাস্তায় নামলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে যায়। এসময় দুর্বৃত্তরা গুলি চালালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন এবং জেলা প্রশাসন প্রথমে খাগড়াছড়ি সদর ও পরে গুইমারা উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে।

১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ চলাকালে গুইমারা উপজেলার রামেছু বাজার এলাকায় সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় একদল উগ্র পাহাড়ি নারী-পুরুষ। এতে অন্তত ১২ জন সেনাসদস্য গুরুতর আহত হন। হামলাকারীরা এসময় দুই বাঙালিকে গুলি করে এবং বেশ কয়েকটি দোকানপাট ও মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি সদস্যরা লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা রাস্তায় টহল জোরদার করেছে।

এদিকে, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্ঠা সুপ্রদীপ চাকমার সভাপতিত্বে সভায় রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভায় সুপ্রদীপ চাকমা পাহাড়ি ও বাঙালি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে বলেন, "পাহাড়ে কেবল সরকারি বাহিনীর কাছেই অস্ত্র থাকবে, অন্য কারও হাতে অস্ত্র থাকার সুযোগ নেই।" তিনি জানমালের নিরাপত্তায় প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেন।

সভায় খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার, সেনাবাহিনীর সদর জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. খাদেমুল ইসলাম, পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েলসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতারা বক্তব্য রাখেন।

‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র নেতারা অভিযোগ করেছেন, তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে বানচাল করতে একটি উগ্রবাদী মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সহিংসতা সৃষ্টি করেছে। ধর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে বলে তারা ঘোষণা দিয়েছেন।

অন্যদিকে, স্থানীয় বাঙালি নেতারাও ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়ে বলেছেন, আন্দোলনের নামে একটি চক্র পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছে।

এদিকে, মারমা সম্প্রদায়ের দুটি সামাজিক সংগঠন ‘মারমা উন্নয়ন সংসদ’ ও ‘মারমা ঐক্য পরিষদ’ চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতি অবসানের লক্ষ্যে অবরোধ প্রত্যাহারের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow