শতবর্ষী লোহার তালা বিলিনের পথে, টিকে আছে ইন্দুরহাটের কয়েকজন কামারের হাতে
পিরোজপুরে নেছারাবাদ উপজেলার ইন্দুরহাট কামারপট্টিতে শত শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য ধরে আজও তৈরি হচ্ছে হাতে বানানো লোহার তালা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই ঐতিহ্যবাহী তালা তৈরির পেশা প্রায় বিলুপ্তির পথে, তবুও কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ কামার এখনো এই প্রাচীন কারিগরি ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
ইন্দুরহাটের এই কামারপট্টিতে তৈরি তালাগুলো সম্পূর্ণভাবে হাতে গড়া। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দক্ষ কামাররা আগুনে লোহা পুড়িয়ে, হাতুড়ির আঘাতে গড়ে তোলেন এই মজবুত তালা। একসময় রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার প্রধান উপকরণ ছিল এই তালা। অতীতে বড় বড় নৌকা, ট্রলার,গুদামঘর ও রাজকীয় সিন্দুকেও ব্যবহৃত হতো এই শক্তিশালী লোহার তালা।
এই তালার বিশেষত্ব হলো এর দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব। সহজে ভাঙা, কাটা বা এসিডে গলানো যায় না। এমনকি বৃষ্টির পানিতেও নষ্ট হয় না এই তালা। তাই আজও অনেক স্বর্ণকার, ব্যবসায়ী ও সম্পদশালী মানুষ তাঁদের সিন্দুক ও দোকানের নিরাপত্তায় এই তালার উপর ভরসা রাখেন।
তালা তৈরির কারিগর রাম কর্মকার জানান,“আমি আর আমার ছেলে অপু কর্মকার এখনো এই কাজ করছি। ব্রিটিশ আমল থেকেই আমাদের পরিবার এই পেশায় জড়িত। আমার ওস্তাদ গান্ধী লাল কর্মকারের কাছ থেকে তালা তৈরি শিখেছি, তিনিও তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছ থেকেই এই শিল্প শিখেছিলেন।”
রাম কর্মকার আরও বলেন, প্রতিদিন একজন কামার সর্বোচ্চ একটি তালা তৈরি করতে পারেন। কিন্তু বাজারে এই তালার দাম কম হওয়ায় আয়ের পরিমাণও খুব সীমিত। ফলে অনেক কামার জীবিকার তাগিদে এই পেশা ছেড়ে অন্য কাজে চলে গেছেন। যারা এখনো টিকে আছেন, তারা ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদেই কাজটি করে যাচ্ছেন, কিন্তু জীবনযাত্রা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।
স্থানীয় হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী কামাল হোসেন বলেন,এই ধরনের তালা আমরা আগে বিক্রি করতাম। মান ভালো হওয়ায় স্থানীয় বাজার ছাড়াও দেশ-বিদেশে এই তালার প্রচুর চাহিদা আছে। কিন্তু উৎপাদন কম হওয়ায় এখন আর বিক্রি করতে পারি না। যদি এ তালার উৎপাদন বাড়ানো যেত, তাহলে মানুষের মূল্যবান সম্পদ রক্ষায় এটি বড় ভূমিকা রাখতে পারত। একই সঙ্গে শত শত মানুষের কর্মসংস্থানও বাড়ত।”
বালি হাড়ি গ্রামের প্রবাসী অলিউল হক অপু বলেন , এই ধরনের তালা আমি মালয়েশিয়াতেও দেখেছি। কিন্তু এটি আমাদের এলাকাতেই তৈরি হয়, তা আগে জানতাম না। যদি এই তালা আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে মানসম্মত উন্নত ভাবে তৈরি করা যায়, তাহলে বিদেশে রপ্তানি করে দেশের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।”
এ বিষয়ে নেছারাবাদ বিসিক কর্মকর্তা রিয়াজ উল হাসান বলেন,ইন্দুরহাটের কামারদের হাতে তৈরি লোহার তালা অত্যন্ত মজবুত ও শক্তিশালী, যা শত শত বছরের পুরনো প্রাচীন ঐতিহ্য ধারণ করে। এটি হারিয়ে যেতে বসেছে ঠিকই, তবে আধুনিকতার ভিড়েও এর নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাজারে এই তালার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যদি এই উদ্যোক্তারা বিসিকের মাধ্যমে সহযোগিতা নিতে চান, আমরা প্রথমে তাদের শিল্প নিবন্ধন দেব। পরবর্তীতে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন হলে বিসিক থেকে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দেব।”
স্থানীয় কামাররা মনে করেন, সরকারি আর্থিক সহায়তা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পেলে আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে এই শিল্পকে নতুনভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। এতে যেমন ঐতিহ্য রক্ষা পাবে, তেমনি দেশের নিরাপত্তার জন্য তৈরি হতে পারে একটি শক্তিশালী দেশীয় ব্র্যান্ড—যা চোর-ডাকাতের হাত থেকে সম্পদ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
ইন্দুরহাটের পুরনো কামারপট্টিতে এখনো ভেসে আসে হাতুড়ির শব্দ, লোহা পুড়ানোর গন্ধ, আর ঐতিহ্য ধরে রাখার নিরলস প্রয়াস। সময়ের পরিবর্তন সত্ত্বেও, কিছু মানুষের ভালোবাসা আর পরিশ্রমেই টিকে আছে এই শতবর্ষী তালা তৈরির ঐতিহ্য।
What's Your Reaction?
মোঃ নাজমুল হোসেন,জেলা প্রতিনিধি, পিরোজপুরঃ