প্রকৃতির বুকে ফোটা কলমি ফুল: গ্রামবাংলার হারানো দিনের স্নিগ্ধ স্মৃতি
গ্রামবাংলার জলাভূমি, খাল-বিল বা পুকুরপাড়ে চোখ মেললেই একসময় দেখা যেত সহজ-সরল এক ফুল- কলমি। সাদা বা হালকা গোলাপি রঙের কুঁকড়ানো পাপড়ির এই ফুল যেন প্রকৃতির আঁচলে জড়িয়ে থাকা একরাশ মুগ্ধতা। কালের পরিক্রমায় অনেক কিছু বদলে গেলেও এই চিরচেনা কলমি ফুলের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য এখনো চোখে পড়ে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার ইছামতি বিলের ধারে।
বাতাসে হালকা দুলে ওঠা কলমি ফুল আজও বাঙালির মননে গ্রামীণ জীবনের মায়াবী স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। এটি কৃষকের পথচলার সঙ্গী, কবির কলমের অনুপ্রেরণা আর সংগীতের সুরে মিশে থাকা এক শান্ত অধ্যায়।
কলমি ফুলের সৌন্দর্যের সাথে জড়িয়ে আছে এক ধরনের স্নিগ্ধ সরলতা। কোনো আড়ম্বর বা দাম্ভিকতা নয়, বরং গ্রামের শান্ত ও লাজুক মেয়ের মতোই এর সৌন্দর্য কোলাহলহীন। ভোরের শুকতারা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই শিশিরভেজা ঘাসের উপর সূর্যের প্রথম আলো পড়তেই এটি ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলে ধরে। এর রঙে তীব্রতা নেই, তবুও মন কেড়ে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে।
কলমি ফুল শুধু প্রকৃতির শোভা নয়, এটি গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাঠের আলপথে বিশ্রামরত কৃষক এই ফুলের দিকে তাকিয়ে খুঁজে পান ক্ষণিকের শান্তি। গাঁয়ের কিশোরী হয়তো আনমনে শাড়ির আঁচলে গুঁজে নেয় কয়েকটি ফুল, আর শিশুরা এটিকে বানিয়ে ফেলে তাদের খেলার সঙ্গী। খাল-পুকুরের জলে ভেসে থাকা কলমি লতার ফাঁকে যখন ফুলগুলো মাথা উঁচু করে ফুটে থাকে, তখন মনে হয় তারা যেন নীরবে বলছ- "কেউ দেখুক বা না দেখুক, ফুটে ওঠাই আমার আনন্দ।"
তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আর নগরায়ণের প্রসারে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক খাল-বিল ও জলাভূমি। এর ফলে একসময়ের সহজলভ্য এই কলমি ফুল এখন হয়ে উঠছে এক দূরবর্তী স্মৃতি বা গল্পের চরিত্র। যেখানে একদিন প্রকৃতিই ছিল মানুষের বড় শিক্ষক, সেখানে আজ কংক্রিটের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে এমন স্নিগ্ধ সৌন্দর্য।
কলমি ফুল আমাদের নীরবে এক গভীর বার্তা দিয়ে যায়। সৌন্দর্য মানে জাঁকজমক বা কোলাহলের প্রকাশ নয়, বরং তা হলো নিজের মতো করে স্নিগ্ধভাবে ফুটে থাকা। জাঁকজমক নয়, সাধারণ স্পর্শই সৌন্দর্যের আসল ভাষা। গ্রামবাংলার শান্ত বিকেলের মতোই কলমি ফুল চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে এক মায়াবী স্মৃতি হয়ে দুলতে থাকবে।
What's Your Reaction?
বিশ্বজিৎ সিংহ রায়, ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি, মাগুরাঃ