অতীতের সকল ভুলের জন্য আমীরে জামায়াতের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা

মোঃ রহমাতুল্লাহ,স্টাফ রিপোর্টারঃ
Oct 25, 2025 - 13:04
 0  4
অতীতের সকল ভুলের জন্য আমীরে জামায়াতের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ হিসেবে, জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডাঃ শফিকুর রহমান দলের অতীত সকল ভুলের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। এই ক্ষমা প্রার্থনার পরিসর শুধু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক নয়, বরং ১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত বিস্তৃত। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তার এই ঘোষণায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসা ও বিতর্কের ঝড় উঠেছে।

স্থানীয় সময় বুধবার (২২ অক্টোবর) নিউইয়র্কে ‘কোয়ালিশন অব বাংলাদেশি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন’ (কোবা) আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ডাঃ শফিকুর রহমান বলেন, "শুধু একাত্তর নয়, সাতচল্লিশ সাল থেকে শুরু করে আজকের দিন (২২ অক্টোবর) পর্যন্ত আমাদের দ্বারা যে যেখানে যত কষ্ট পেয়েছেন, আমরা বিনাশর্তে তাদের কাছে মাফ চাই। এটা গোটা জাতি হলেও চাই, ব্যক্তি হলেও চাই।"

তিনি স্বীকার করেন যে, মানুষ হিসেবে বা দল হিসেবে তাদের ভুল হতে পারে। তার ভাষায়, "আমাদের একশটির মধ্যে ৯৯টি সিদ্ধান্ত সঠিক, একটি তো বেঠিক হতে পারে। সেই বেঠিক একটি সিদ্ধান্তের জন্য জাতির ক্ষতি হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমার কোনো সিদ্ধান্তের জন্য যদি জাতির ক্ষতি হয় তাহলে আমার মাফ চাইতে অসুবিধা কোথায়?"

মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে ডাঃ শফিকুর রহমান বলেন, একাত্তরে এদেশের মানুষের স্বাধীনতার প্রত্যাশাকে তৎকালীন জামায়াত নেতৃত্বের সম্মান করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, "একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা ছিল, তা অস্বীকার করছি না। তখন দলটি মনে করেছিল, পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ থাকা দরকার।" তবে সেই সময়ের সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করার উপযুক্ত ব্যক্তি তিনি নন বলে উল্লেখ করেন।

জামায়াত আমীর আরও জানান যে, এই ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। ইতোপূর্বে দলের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম এবং মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীও দলের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি তিনি নিজেও কিছুদিন আগে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তবে এবারের ক্ষমা প্রার্থনার ভাষা ছিল সবচেয়ে স্পষ্ট এবং নিঃশর্ত।

ডাঃ শফিকুর রহমানের এই ঘোষণায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেক বিশ্লেষক এটিকে একটি ইতিবাচক এবং সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, যা দেশের রাজনীতিতে বিভেদ কমাতে সাহায্য করতে পারে। তারা মনে করছেন, এই আন্তরিকতা জামায়াতের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।

তবে, একটি বড় অংশ এই ক্ষমা প্রার্থনার উদ্দেশ্য এবং আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মতে, এটি জামায়াতের একটি রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে, যার মাধ্যমে দলটি পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বিষয়টিকে 'কৌশল' হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ক্ষমা চাইলেও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বন্ধ হবে না। সমালোচকরা বলছেন, একাত্তরে গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের দায় শুধু 'ভুল' স্বীকার করে এড়ানো যায় না।

মতবিনিময় সভায় ডাঃ শফিকুর রহমান বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়েও কথা বলেন। তিনি জানান, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে সংখ্যালঘুরা সাংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারবে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্মানজনক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় জামায়াত। তিনি আশ্বস্ত করেন যে, জামায়াত সরকার গঠন করলে বাংলাদেশ কখনো আফগানিস্তান বা পাকিস্তান হবে না, বরং তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়েই এগিয়ে যাবে।

এই ঐতিহাসিক ক্ষমা প্রার্থনার পর জামায়াতে ইসলামীর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পথচলা কোন দিকে মোড় নেয়, তা সময়ই বলে দেবে। তবে, এই ঘোষণা যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow