দিকহারা আলফাডাঙ্গার প্রাথমিক শিক্ষা, কিনারাহীন সংকটে শিক্ষার্থীরা

একটি স্কুল... তার প্রাণ হলো শিক্ষার্থীরা, মস্তিষ্ক হলেন শিক্ষকেরা, আর হৃৎপিণ্ড? তিনি প্রধান শিক্ষক। কিন্তু ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় সেই হৃৎপিণ্ডই যেন অচল হয়ে পড়েছে ৭৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫৫টিতেই। নেতৃত্বহীন এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কেবলই ইটের দালান, যেখানে নেই কোনো দিকনির্দেশনা, নেই শৃঙ্খলার স্বর। এক ভয়াবহ সংকটের আবর্তে ডুবে যাচ্ছে উপজেলার পুরো প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা, আর এর সাথে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে হাজারো কোমলমতি শিশুকে।
ভেতরের চিত্রটা আরও ভয়াবহ। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ ও পদোন্নতি বন্ধ থাকায় তৈরি হয়েছে এই নেতৃত্বশূন্যতা। পরিস্থিতি সামাল দিতে সহকারী শিক্ষকদের কাঁধেই চাপানো হয়েছে 'ভারপ্রাপ্ত' প্রধান শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব। ফলে তারা এখন দুই নৌকার যাত্রী। ফাইলের পাহাড় ডিঙিয়ে যখন তারা ক্লাসে পৌঁছান, তখন পাঠদানে প্রাণ দেওয়ার মতো শক্তি আর অবশিষ্ট থাকে না। এই বোঝার ভারে ন্যুব্জ শিক্ষকেরা না পারছেন স্কুলকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে, না পারছেন শিক্ষার্থীদের মন দিয়ে পড়াতে।
এই সংগ্রামের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি দিগনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জেবা পারভীন। তার কথায় ঝরে পড়ে অসহায়ত্বের সুর, "অফিসের কাজ আর ক্লাস—দুই দিক সামলাতে গিয়ে আমাদের নাভিশ্বাস উঠছে। একটি করতে গেলে অন্যটি জমে যায়। এই সীমাহীন চাপে মানসম্মত পাঠদান অসম্ভব হয়ে পড়েছে।" একই আর্তনাদ আলফাডাঙ্গা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জেসমিন আরা সুলতানারও, যিনি প্রায় সাতশ শিক্ষার্থীর দায়িত্বের পাশাপাশি প্রশাসনিক জটিলতায় দিশেহারা।
সন্তানদের শিক্ষাজীবন ধ্বংসের মুখে দেখে অভিভাবকদের বুকে জমেছে ক্ষোভ ও হতাশা। তাদের আর্তনাদ—শুধু শিক্ষক নন, বিদ্যালয়ে একজন অভিভাবক চাই। দ্রুত স্থায়ী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এই মৃত্যু পথযাত্রী শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচানোর জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
এই সংকটের শেকড় গভীরে। ২০১৭ সাল থেকে নিয়োগ বন্ধ এবং জাতীয়করণকৃত কিছু বিদ্যালয়ের পদ নিয়ে উচ্চ আদালতের মামলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম শুধু আশ্বাসের বাণীই শোনাতে পারলেন। তিনি বলেন, "আমরা তালিকা পাঠিয়েছি, সমাধানের চেষ্টা চলছে।" কিন্তু তার কথায় মামলার বেড়াজালের যে ইঙ্গিত, তাতে এই "চেষ্টা" কবে আলোর মুখ দেখবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
কর্তৃপক্ষের কাগুজে আশ্বাস আর কঠিন বাস্তবতার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে আলফাডাঙ্গার শৈশব। প্রশ্ন হলো, আলফাডাঙ্গার এই ৫৫টি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের শূন্য চেয়ারগুলো কি শেষ পর্যন্ত হাজারো শিশুর ভবিষ্যৎকেই শূন্য করে দেবে? এর দায় কে নেবে?
What's Your Reaction?






