বাবুই পাখি-প্রকৃতির ক্ষুদ্র শিল্পী, যে গাঁথে স্বপ্নের বাসা
মাগুরার মহম্মদপুর পার্শ্ববর্তী একটি উপজেলায় মধুমতি নদীর পাড়ে তাল গাছে অসংখ্য বাবুই পাখির বাসা বাধার চিত্র চোখে পড়ে। বাতাসে দোল খাওয়া খড়কুটোর এই শৈল্পিক বুনন দেখে মনে হয়, প্রকৃতি যেন নিজ হাতে তার তাঁতে বোনা স্বপ্নের আশ্রয়। এই নয়নাভিরাম দৃশ্য এখন মুগ্ধ করছে প্রকৃতিপ্রেমীদের।
বাংলার মানুষ ভালোবেসে বাবুইকে “শিল্পী পাখি” নামে ডাকে। এই ক্ষুদ্র পাখিটি কেবল একটি প্রাণী নয়, সে প্রকৃতির এক অনন্য স্থপতি। ধানক্ষেতের পাশে, গ্রামের প্রান্তের উঁচু তাল বা খেজুরগাছের ডালে নিপুণ হাতে সে গড়ে তোলে তার শিল্পের রাজপ্রাসাদ।
আশ্চর্যজনকভাবে, এই अद्भुत সুন্দর বাসা তৈরির সম্পূর্ণ কারিগর পুরুষ বাবুই। ঘাস, খড়, পাটের আঁশ আর তালপাতার কচি তন্তু দিয়ে একাই সে বুনে চলে এক অনিন্দ্যসুন্দর শিল্পকর্ম। বাসার নিচের দিকে থাকা লম্বা নলাকার প্রবেশপথটি কেবল শৈল্পিক নয়, এটি শত্রুর হাত থেকে পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার এক নিখুঁত কৌশল। বাসা তৈরির পর পুরুষ বাবুই তার সঙ্গিনীকে আমন্ত্রণ জানায়। স্ত্রী বাবুই বাসাটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে পছন্দ করলে তবেই সেখানে সংসার পাতে তারা। বাসা পছন্দ না হলে পুরুষ পাখিটি হাল না ছেড়ে নতুন করে আরও সুন্দর বাসা বানাতে শুরু করে, যা শ্রম ও ধৈর্যের এক অপূর্ব নিদর্শন।
বিজ্ঞানীদের মতে, বাবুই প্রকৃতির অন্যতম বুদ্ধিমান পাখি। তাদের তৈরি বাসার গঠন ও স্থায়িত্ব প্রমাণ করে এদের অসাধারণ স্থাপত্য জ্ঞান ও পরিকল্পনা বোধ রয়েছে।
শ্রম, নৈপুণ্য ও মমতার প্রতীক এই বাবুই পাখি শত শত বছর ধরে মিশে আছে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ বা পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের গ্রামীণ কাব্যে বাবুই পাখি মানেই এক শান্ত, পরিশ্রমী ও শিল্পপ্রেমী জীবনের প্রতিচ্ছবি।
আজকের কংক্রিটের পৃথিবীতে যখন প্রকৃতি প্রায় কোণঠাসা, তখন বাবুই পাখির এই শিল্পকর্ম আমাদের এক অমূল্য বার্তা দেয়- প্রকৃত সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় শ্রম দিয়ে, আর শিল্পের জন্ম হয় ভালোবাসা থেকে। বাবুই পাখি তাই কেবল ডালে ঝুলে থাকা একটি বাসার গল্প নয়; এ এক জীবন্ত দর্শন, যেখানে মিশে আছে শ্রমের মহিমা, প্রকৃতির কবিতা আর জীবনের নান্দনিকতা।
What's Your Reaction?
বিশ্বজিৎ সিংহ রায়, ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি, মাগুরাঃ