ভাঙনের হুমকিতে আলফাডাঙ্গার আল-হেরা দাখিল মাদ্রাসা, শিক্ষা ও আশার আলো বাঁচাতে এলাকাবাসীর আকুল আবেদন

একদিকে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রাখার আকুতি, অন্যদিকে কূল ভেঙে এগিয়ে আসা মধুমতীর সর্বগ্রাসী গর্জন। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার চরখোলাবাড়িয়া গ্রামে এখন চলছে এমনই এক অসম যুদ্ধ। এই যুদ্ধে স্বপ্নের বাতিঘর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এনবিডিসি আল-হেরা দাখিল মাদ্রাসা আজ তার অস্তিত্ব রক্ষার শেষ লড়াই লড়ছে। প্রমত্তা নদী তার হিংস্র থাবা বাড়িয়ে শুধু একটি ইটের দালান নয়, গিলে খেতে উদ্যত হয়েছে চরাঞ্চলের শত শত শিশুর সোনালী ভবিষ্যৎ, একটি এতিমখানার আশ্রয় আর নারী শিক্ষার একমাত্র আশার প্রদীপ। ভাঙনের প্রতিটি শব্দ যেন এক আসন্ন বিদায়ের করুণ সুর বাজাচ্ছে। প্রশাসনের আশ্বাস আর নদীর স্রোতের এই অসম দৌড়ে কে জিতবে, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো অসহায় মানুষের মনে।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। সর্বগ্রাসী মধুমতীর হিংস্র স্রোত ফণা তোলা সাপের মতো ছোবল মারছে মাদ্রাসার ভিত্তিমূলে। যেকোনো মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে মূল ভবন। মাদ্রাসার প্রাঙ্গণে অসহায় দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে ফরিয়াদ করছেন প্রধান শিক্ষক আলমগীর হোসেন খান। তার চোখের জলে মিশে গেছে চরাঞ্চলের হাজারো মানুষের হাহাকার। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, "এই আল-হেরা মাদ্রাসা শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি চরাঞ্চলের শত শত ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যতের একমাত্র আশ্রয়। বিশেষ করে মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য এটিই একমাত্র কেন্দ্র। আজ নদী আমাদের বুক চিরে নিচ্ছে। আমরা শুধু চাই এই শিক্ষালয়টা যেন বেঁচে থাকে।"
এর মাত্র দুদিন আগে, বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) মাদ্রাসার সুপার মোঃ আব্দুর রব ফেসবুক লাইভে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার সেই কান্না ছুঁয়ে গেছে হাজারো মানুষকে। তিনি বলেন, "আমাদের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর সানোয়ার হোসেন বলতেন, সাহায্য করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই কোনো টাকা লাগে নাই, এমপিও হয়ে গিয়েছিল। এখন নদী ভাঙনের কারণে সব কিছু হারানোর পথে। যদি দ্রুত জিও ব্যাগ ডাম্পিং না করা হয়, এই নবীর ঘর বিলীন হয়ে যাবে।"
এই আকুতি শুধু শিক্ষকদের নয়, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চরের প্রতিটি কোণায়। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল খালেক মোল্লার কণ্ঠে ঝরে পড়ে একরাশ হতাশা, "নদীভাঙনে আমরা ঘরবাড়ি হারিয়েছি, এখন চাই না আমাদের সন্তানদের শিক্ষার আলোটুকুও নিভে যাক। আল-হেরা মাদ্রাসা রক্ষা পাওয়া মানে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা।"
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সম্প্রতি আল-হেরা দাখিল মাদ্রাসার জন্য একটি নতুন ভবনের টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু যে মাটির ওপর সেই স্বপ্নিল ভবন গড়ে ওঠার কথা, সেই মাটিই আজ বিলীন হওয়ার পথে। মাদ্রাসার সুপার আব্দুর রব আরও বলেন, "আমরা বারবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আমাদের দাবি, জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলে সাময়িকভাবে ভাঙন ঠেকিয়ে পরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হোক। এই প্রতিষ্ঠানটি হারিয়ে গেলে কয়েকশ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।"
এ বিষয়ে আলফাডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল ইকবাল আশার বাণী শুনিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে আলোচনার মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলার প্রস্তুতি চলছে।
কিন্তু মধুমতীর স্রোতের বেগ আমলাতান্ত্রিক প্রস্তুতির চেয়ে অনেক বেশি। এনবিডিসি আল-হেরা দাখিল মাদ্রাসা, যা বর্তমানে শতাধিক শিক্ষার্থীর কলরবে মুখরিত এবং চরাঞ্চলে নারী শিক্ষার প্রসারে এক অনন্য বাতিঘর, তা এখন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে লড়ছে।
প্রশ্ন এখন একটাই- প্রশাসনের আশ্বাস আর মধুমতীর স্রোতের মধ্যে এই অসম যুদ্ধে কে জিতবে? একটি শিক্ষালয় কি টিকে থাকতে পারবে প্রকৃতির রোষানল থেকে, নাকি শত শত শিক্ষার্থীর স্বপ্ন নদীর অথৈ জলে হারিয়ে যাবে? উত্তরটা সময়ের হাতে, তবে সেই সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
What's Your Reaction?






