তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে, আশায় বুক বেঁধেছে নদী পাড়ের মানুষ

অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে বহু প্রতীক্ষিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা। প্রায় এক দশক ধরে তিস্তা অববাহিকার মানুষের আন্দোলনের পর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে এই প্রকল্পে নতুন করে গতি সঞ্চার হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে, যার কাজ ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
সম্প্রতি, চীনের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল তিস্তা এলাকা পরিদর্শন করেছে। ডাইরেক্টর অব দ্য পলিটিক্যাল সেকশন জং জিং এর নেতৃত্বে এই দলটি বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি এবং 'তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ' ও 'তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনে'র মতো সামাজিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। এই বৈঠককে কেন্দ্র করে নদীপাড়ের মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জেগেছে।
'তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদে'র সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানি জানান, "দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করে আসছি। পূর্ববর্তী সরকার এটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলেও, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে তিস্তা পাড়ের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে।"
একই সুর শোনা গেল পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শাফিয়ার রহমানের কণ্ঠেও। তিনি বলেন, "২০১৪ সাল থেকে শুষ্ক মৌসুমে ভারত তিস্তার পানি সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেয়, আবার বর্ষায় গজলডোবার সব গেট খুলে দেওয়ায় উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলা ভয়াবহ বন্যা ও ভাঙনের শিকার হয়।" রিভারাইন পিপলের একটি গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি বছর তিস্তার ভাঙন ও বন্যায় এই পাঁচ জেলার বাসিন্দাদের প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়, এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
'তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনে'র প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলুর মতে, এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তিস্তার দুই পাড়ে পুনরুদ্ধার করা ১৭৪ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ইকোপার্ক, শিল্পাঞ্চল, আধুনিক কৃষি খামার, এবং স্যাটেলাইট টাউন গড়ে উঠবে। এছাড়াও, তিস্তা নদী খননের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার সঙ্গে সারা বছর নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে এবং এর শাখা-প্রশাখাগুলো জলাধার হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, ১০ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের খসড়া প্রস্তাবনা চীনের কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, "২০২৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে এবং প্রথম পাঁচ বছরে সেচ, ভাঙন রোধ ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।" এই বছরের অক্টোবরের মধ্যে প্রকল্পের ডিজাইন চূড়ান্ত হতে পারে এবং এরপরই দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এ লক্ষ্যে একাধিক গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে।
উত্তরাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন জড়িত এই তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে। এর সফল বাস্তবায়ন শুধু নদীপাড়ের মানুষের ভাগ্যই পরিবর্তন করবে না, বরং দেশের অর্থনীতিতেও একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
What's Your Reaction?






