ফরিদপুরে বেদে পল্লীর মানবেতর জীবন: শিক্ষার আলোয় নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন

কালের বিবর্তনে যাযাবর জীবন ছেড়ে ফরিদপুরের মুন্সিবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছে বেদে সম্প্রদায়। তবে जमिनीবাসী হলেও তাদের জীবনে আসেনি স্থিরতা। নিজস্ব ভিটেমাটি না থাকা এবং ঐতিহ্যবাহী পেশা হারিয়ে যাওয়ায় এই জনগোষ্ঠীর জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা। জীবিকার তাগিদে তারা এমন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে যা সাধারণ মানুষের কাছে হয়রানিমূলক এবং সমাজের জন্য অবক্ষয়মূলক বলে বিবেচিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার আলোয় নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করার মাধ্যমে এই চক্র ভাঙার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও স্থানীয় প্রশাসন।
একসময়কার সাপ খেলা আর তাবিজ-কবজ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা বেদেদের চিত্র এখন শুধুই অতীত। ফরিদপুরের মুন্সিবাজারে হামিম গ্রুপের একটি প্লটে অস্থায়ী ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছে প্রায় ৮০টি বেদে পরিবার। চিরায়ত পেশা হারিয়ে পুরুষরা প্রায় বেকার, আর নারীরা শিশুদের নিয়ে শহরের পথে পথে এক ভিন্নধর্মী ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছে। তারা সরাসরি হাত পেতে সাহায্য চাওয়ার পরিবর্তে পথচারীদের ঘিরে ধরে টাকা আদায়ে বাধ্য করে, যা জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
ফরিদপুরের বায়তুল আমান এলাকার বাসিন্দা শামীম রানা বলেন, "জনতা ব্যাংকের মোড়ে প্রায়ই বেদে নারী ও শিশুরা আমাকে রিকশা থেকে নামার সময় ঘিরে ধরে। টাকা একরকম কেড়েই নিতে চায়। বাধ্য হয়ে ৫০ টাকা দিতে হয়। এটা যাত্রীদের জন্য চরম হয়রানি।"
মুন্সিবাজারের এই বেদে পল্লীতে প্রায় ৩০০ মানুষ অস্বাস্থ্যকর ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশে জীবনযাপন করছে। মৌলিক নাগরিক সুবিধা, বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে তারা পুরোপুরি বঞ্চিত। জন্ম নিবন্ধন না থাকায় তাদের সন্তানেরা পোলিও টিকার মতো অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকেও বাদ পড়ছে। সজীব নামের এক বেদে কিশোর জানায়, সে পোলিও টিকা পায়নি এবং তার জন্ম নিবন্ধন সনদও নেই, যার শারীরিক প্রভাব তার শরীরে স্পষ্ট।
বেদে পল্লীর সর্দারের স্ত্রী লাভলী আক্ষেপ করে বলেন, "অভাবে স্বভাব নষ্ট। পেটের দায়ে ভিক্ষা করি। সরকার যদি আমাদের থাকার জন্য একটু ঘর দিত, তাহলে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারতাম।"
এই সম্প্রদায়ের শিশুদের অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন শঙ্কা বাড়ছে, তখন আশার আলো হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে 'মানুষ মানুষের জন্য' নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তারা 'প্রজন্মের আলো' নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে সপ্তাহে তিন দিন বেদে শিশুদের পাঠদান করা হয়। সংগঠনটির সভাপতি জাহিদ ইসলাম বলেন, "আমরা চাই এই শিশুরা শিক্ষার মাধ্যমে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখুক এবং ভিক্ষাবৃত্তির মতো অসম্মানজনক পেশা থেকে বেরিয়ে আসুক। আমরা সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা কামনা করছি।"
বেদেদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। ফরিদপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইসরাত জাহান জানিয়েছেন, জন্ম নিবন্ধন না থাকার কারণে বেদে সম্প্রদায় বিভিন্ন সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি বলেন, "বর্তমানে তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও, তারা যদি জন্ম নিবন্ধন ও নাগরিকত্ব পেতে আগ্রহী হয়, তবে প্রশাসন সব ধরনের সহযোগিতা করবে।"
সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং শিক্ষার প্রসারই পারে এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে। প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর উদ্যোগ হয়তো সত্যিই একদিন এই প্রজন্মের ভাগ্যের চাকা ঘোরাবে।
What's Your Reaction?






