কিংবদন্তী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ৫৩তম প্রয়াণ দিবস

সুরের জগতে সম্রাট একজনই, যার সুরের মূর্ছনায় আজও মোহিত হয় বিশ্ব। ৬ই সেপ্টেম্বর ২০২৫, সেই সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ৫৩তম মহাপ্রয়াণের দিন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই কিংবদন্তী শিল্পী ১৯৭২ সালের এই দিনে ভারতের মাইহারে তাঁর মদিনা ভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর চলে যাওয়ার অর্ধশতাব্দী পরেও সুরের আকাশে তিনি এক চিরভাস্বর নক্ষত্র।
১৮৬২ সালের ৮ই অক্টোবর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ত্রিপুরা জেলার (বর্তমান বাংলাদেশর ব্রাহ্মণবাড়িয়া) শিবপুর গ্রামে এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আলাউদ্দিন খাঁ। পিতা সবদর হোসেন খাঁ এবং মাতা সুন্দরী বেগম। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি ছিল তাঁর দুর্নিবার আকর্ষণ। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চার দেয়াল তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। মাত্র আট বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি পাড়ি জমান সঙ্গীতের মক্কা কলকাতায়।
তাঁর সঙ্গীত সাধনার পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। কলকাতায় এসে তিনি প্রখ্যাত সঙ্গীত সাধক গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এরপর বিভিন্ন ওস্তাদের নিকট থেকে সরোদ, সেতার, বেহালাসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্রে অবিশ্বাস্য দক্ষতা অর্জন করেন। কিংবদন্তী ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর নিকট বীণা শিক্ষার মাধ্যমে তাঁর দীর্ঘ সঙ্গীত শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে 'মাইহার ঘরানা' বা 'আলাউদ্দিন ঘরানা' নামে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেন, যা আজও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। তিনিই প্রথম রাগ সঙ্গীতকে রাজদরবারের কঠোর অনুশাসন থেকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। ১৯৩৫ সালে বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সঙ্গে বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়ে তিনি পাশ্চাত্য শ্রোতাদের কাছে ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের অপার সৌন্দর্য তুলে ধরেন। লন্ডনে তাঁর পরিবেশনায় মুগ্ধ হয়ে ব্রিটিশ রানী তাঁকে "সুর সম্রাট" উপাধিতে ভূষিত করেন।
তাঁর সৃষ্ট রাগগুলোর মধ্যে মদন মঞ্জরী, শোভাবতী, হেমন্ত এবং দুর্গেশ্বরী আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের বিমোহিত করে। সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ভারত সরকারের 'পদ্মভূষণ' ও 'পদ্মবিভূষণ' খেতাবে ভূষিত হন। এছাড়াও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'দেশিকোত্তম' এবং দিল্লি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
তাঁর হাতেই তৈরি হয়েছেন বিশ্বখ্যাত সব সঙ্গীতশিল্পীরা, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন তাঁর পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খান, কন্যা অন্নপূর্ণা দেবী, পণ্ডিত রবি শঙ্কর এবং পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দিকপালেরা।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ শুধু একজন সঙ্গীতজ্ঞই ছিলেন না, ছিলেন একজন বিনয়ী ও ধার্মিক মানুষ। জীবনের শেষ দিকে তিনি জন্মভূমি শিবপুরে এসে মায়ের ইচ্ছাপূরণে একটি পুকুর খনন ও পাকা মসজিদ নির্মাণ করেন। সুরের এই সম্রাট তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ও কর্মের মাধ্যমে সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে চির অমর হয়ে থাকবেন। তাঁর প্রয়াণ দিবসে সুরের এই জাদুকরকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
What's Your Reaction?






