কালের সাক্ষী বাউশখালী জমিদার বাড়ি: জৌলুস হারিয়ে এক বুক হাহাকার

চুন-সুরকির গাঁথুনি আর নয়নাভিরাম কারুকার্যে ভরা এক রাজকীয় আভিজাত্য। কালের বিবর্তনে সেই জৌলুস হারিয়ে ফরিদপুরের বাউশখালী জমিদার বাড়ি আজ দাঁড়িয়ে আছে এক বুক হাহাকার নিয়ে। দুই শতাব্দীর ইতিহাস যেন ফিসফিস করে বলছে তার হারিয়ে যাওয়া গৌরবের কথা।
ফরিদপুর জেলার সালথা উপজেলার বল্লভদি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত বাউশখালী গ্রামে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি একসময় মানুষের পদচারণায় মুখর ছিল, আজ তা কেবলই নিস্তব্ধ এক স্মৃতিস্তম্ভ। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ইতিহাসের এই অমূল্য দলিলটি হারাতে বসেছে তার শেষ চিহ্নটুকুও।
প্রায় ১৭৬০ সালের দিকে সিংহ পরিবার এই জমিদার বাড়িতে বসবাস শুরু করে। পরিবারের शुरुआती সদস্যদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া না গেলেও, ১৮৫৯ সালে জন্মগ্রহণকারী যতীন্দ্রনাথ সিংহ রায় বাহাদুর ছিলেন এই বংশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি প্রায় ৩০ বছর ব্রিটিশ সরকারের অধীনে বঙ্গীয় সিভিল সার্ভিসে ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং ফরিদপুরের একাংশে জমিদারিত্ব করেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সরোজিনী সিংহ আমৃত্যু এখানেই বসবাস করতেন। তবে তাঁদের সমাধিস্থল আজও অজানা রয়ে গেছে।
যতীন্দ্রনাথ সিংহের একমাত্র পুত্র সুরেন্দ্রনাথ সিংহ কলকাতায় চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত থাকলেও, তাঁর পুত্র সত্যজিৎ সিংহ (বৈদ্যনাথ বাবু) ১৯৫২ সালে স্ত্রী রেখা রাণী সিংহকে নিয়ে বাউশখালী ফিরে আসেন এবং পুনরায় এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। সত্যজিৎ সিংহ ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক। তিনি এলাকার মানুষের কল্যাণে হাট-বাজার, স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য উদার হস্তে জমি দান করেন। ২০১৩ সালে সত্যজিৎ সিংহ এবং ২০১৫ সালে তাঁর স্ত্রী রেখা রাণী সিংহ মৃত্যুবরণ করলে, তাঁদেরকে সিংহবাড়ি সংলগ্ন দুর্গামন্দিরের পাশেই সমাহিত করা হয়।
বর্তমানে সিংহ পরিবারের কেউ বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন না। মৃত্যুর পূর্বে রেখা রাণী সিংহ তাঁদের রেখে যাওয়া সমস্ত সম্পত্তি, ঠাকুরদালান ও জমিদার বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব 'রাধাগোবিন্দ ট্রাস্ট'-এর হাতে তুলে দেন।
প্রাসাদতুল্য এই জমিদার বাড়িতে রয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন মন্দির এবং দুটি তিনতলা প্রাচীন ভবন। একসময় যেখানে উৎসবের আমেজ আর কোলাহল লেগেই থাকত, আজ সেখানে কেবলই ভাঙনের শব্দ আর শূন্যতা। মূল্যবান অলংকার, পাথরের মূর্তি, তামা-কাঁসার আসবাবপত্রের কিছুই আজ অবশিষ্ট নেই।
স্থানীয় বল্লভদি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার সাইফুর রহমান শাহীন বলেন, "জমিদার বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আমাদের ইতিহাস রক্ষার্থে এটি দ্রুত সংস্কার করে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।"
বাউশখালী জমিদার বাড়ি কেবল একটি ইমারত নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক জীবন্ত সাক্ষী। এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটিকে অবহেলার অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে দেওয়া অনুচিত। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগ এবং স্থানীয় জনগণের সচেতনতাই পারে এই রাজকীয় স্মৃতিচিহ্নকে কালের গর্ভ থেকে রক্ষা করতে।
What's Your Reaction?






