জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র মতবিরোধ

২০২৪ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর খসড়া প্রকাশ পেতেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র উত্তেজনা ও মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। গত সোমবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এই খসড়া পাঠানোর পর থেকেই এর বিভিন্ন ধারা ও প্রস্তাবনা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। প্রধান অভিযোগ, খসড়াটি শুধু জুলাই অভ্যুত্থানকে একতরফাভাবে মহিমান্বিত করেছে, কিন্তু বিগত দেড় দশকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে রাজনৈতিক দলগুলোর সংগ্রাম এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে যথাযথ স্বীকৃতি দেয়নি। সনদ বাস্তবায়নে দুই বছরের সময়সীমা নির্ধারণের প্রস্তাব নিয়েও দেখা দিয়েছে তীব্র অসন্তোষ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ও বিশ্লেষকদের মতে, সনদের প্রাথমিক খসড়াটি বেশ কিছু মৌলিক বিষয়ে অসম্পূর্ণ ও হতাশাজনক। প্রধান আপত্তিগুলো হলো, এতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য গণতন্ত্রকামী দলগুলোর দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কোনো স্বীকৃতি নেই। বিশেষভাবে, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে যে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, খসড়ায় সে বিষয়ে কোনো উল্লেখ না থাকায় অনেকেই অবাক হয়েছেন। সবচেয়ে বড় অভিযোগ, খসড়ায় শুধু জুলাই শহীদ ও যোদ্ধাদের মহিমান্বিত করা হয়েছে, কিন্তু যে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত এবং যেখানে লাখো মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন, সেই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়নি। অনেক দলের মতেই, জুলাই অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই ধারাবাহিকতা, কিন্তু খসড়ায় সেই সংযোগ স্থাপন করা হয়নি।
খসড়া হাতে পাওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ বিষয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, তারা খসড়াটি আরও পর্যবেক্ষণ করছেন এবং ৩১ জুলাইয়ের পর এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করবেন।
তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী খসড়াটিকে সরাসরি ‘অসম্পূর্ণ’ এবং কিছু অংশকে ‘বিপজ্জনক’ বলে আখ্যা দিয়েছে। দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, "যদি এটাই মূল কথা হয়, তাহলে একে গ্রহণ করা যাবে না।" দলটি জানিয়েছে, তারা নিজস্ব একটি খসড়া সনদ তৈরি করে কমিশনে জমা দেবে।
জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রক্রিয়াগত ত্রুটির অভিযোগ তুলেছে। দলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, "আলোচনার পদ্ধতি নিয়েই যেখানে আলোচনা হয়নি, সেখানে হঠাৎ করে জুলাই সনদের খসড়া প্রকাশ করা সঠিক কাজ নয়। আমরা এটির তীব্র বিরোধিতা করছি।"
অন্যদিকে, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি সনদ বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার বিরোধিতা করেছে। দলের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু মনে করেন, "আন্তরিকতা থাকলে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই (সনদ) বাস্তবায়ন করা সম্ভব। ডকট্রিন অব নেসেসিটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে কীভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়, সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে।"
বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি) এবং গণঅধিকার পরিষদ খসড়ায় মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি না থাকায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বিএলডিপি চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন সেলিম বলেন, "জুলাইয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে একাত্তরে। খসড়ায় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়ের স্বীকৃতি থাকলে এটি পরিপূর্ণ গ্রহণযোগ্য হতো।" গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসানও একই সুরে বলেন, "মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় জুলাই এসেছে।"
ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম তার ফেসবুক পোস্টে একটি কড়া বার্তা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, "জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ কোনো দলের চিন্তার অনুলিপি হলে ছাত্র-জনতা মেনে নেবে না। প্রয়োজনে আবার জুলাই ফিরে আসবে। কিন্তু কোনো দল বা গোষ্ঠীর তাঁবেদারি মেনে নেওয়া হবে না।"
এই পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’ হিসেবে দেখছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মো. সাহাবুল হক। তিনি বলেন, "২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে কিংবা কিছুদিনের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণা হওয়ার দরকার ছিল, সেটি হয়নি। জাতি হিসেবে আমাদের এটি সম্মিলিত ব্যর্থতা। এখন যেটি শুরু হয়েছে, সেটি হলো স্বার্থের দ্বন্দ্ব। সবাই যে যার জায়গা থেকে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের ক্রেডিট নিতে চাচ্ছে।" তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দিন যত যাবে দলগুলোর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হবে। তার মতে, ঐকমত্য কমিশনের উচিত শুধু রাজনৈতিক দল নয়, জুলাই অভ্যুত্থানের সকল অংশীদারকে নিয়ে বসে অতি দ্রুত সনদটি চূড়ান্ত করা, অন্যথায় এর ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
এই পরিস্থিতিতে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ আশ্বস্ত করেছেন যে এটি একটি প্রাথমিক খসড়া মাত্র এবং ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সনদ প্রণয়ন করা হবে। তবে দলগুলোর কঠোর অবস্থান এবং মৌলিক বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে সনদ চূড়ান্ত করার পথটি যে বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে, তা স্পষ্ট।
What's Your Reaction?






