ল্যাব আছে শিক্ষক নেই, ৪০০ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

"বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু স্কুলে বিজ্ঞানের কোনো শিক্ষকই নেই। বাধ্য হয়ে পড়তে হচ্ছে মানবিকে।" – এই হতাশা আর ক্ষোভ শুধু একজন শিক্ষার্থীর নয়, বান্দরবানের থানচি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থীর, যারা এক নির্মম বাস্তবতার শিকার। ইংরেজি, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক ছাড়াই চলছে উপজেলার এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যার ফলস্বরূপ এবারের এসএসসি পরীক্ষায় নেমেছে ভয়াবহ বিপর্যয়।
চলতি বছর বিদ্যালয়টি থেকে ৮৪ জন পরীক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাস করেছে মাত্র ৩৬ জন। পাসের হার মাত্র ৪৩ শতাংশ, যা গত বছরের ৭১ শতাংশ থেকে এক বিশাল পতন। এই ফলাফল বিপর্যয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন অভিভাবকরা, আর চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী।
১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়টি ২০১৪ সালে সরকারি করা হলেও, এক দশকেও বাড়েনি শিক্ষকের পদ, নিয়োগ পায়নি বিষয়ভিত্তিক কোনো শিক্ষক। বর্তমানে প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ৫ জন, যেখানে প্রয়োজন অন্তত পক্ষে ১৪ জন। ইংরেজি, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিভাগেই শিক্ষকের পদ শূন্য। ফলে, বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিদ্যালয়ে পা রাখা শিক্ষার্থীরাও বাধ্য হচ্ছে মানবিক বিভাগে পড়তে।
সরেজমিনে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় এক করুণ চিত্র। প্রধান শিক্ষকের চোখেমুখে একরাশ হতাশা। আধুনিক বিজ্ঞানাগার, আইসিটি ও কম্পিউটার ল্যাব থাকলেও সেগুলো অকেজো পড়ে আছে। শতাধিক কম্পিউটার ভাইরাস আর অযত্নে নষ্ট হওয়ার পথে, কারণ সেগুলো দেখানোর মতো কোনো শিক্ষকই নেই।
নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মংসাই মারমা, তৈমতি ত্রিপুরারা জানায়, "আমাদের ইংরেজি, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার কোনো শিক্ষক নেই। শিক্ষকরা অনেক আন্তরিক, কিন্তু তারা তো আর সব বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নন। ক্লাসে বিষয়ভিত্তিক পড়ার চেয়ে গল্পগুজবই বেশি হয়। সিনিয়র ভাই-বোনদের মতো আমাদের পরীক্ষার ফল নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছি।"
এই সংকটের চিত্র আরও করুণভাবে ফুটে ওঠে বাংলা বিষয়ের শিক্ষক মোঃ শাহাদাৎ হোসেনের কথায়। তিনি বলেন, "আমি বাংলার শিক্ষক, কিন্তু আমাকে বাধ্য হয়ে ইংরেজি, বিজ্ঞানসহ প্রতিদিন চারটি বিষয়ে ক্লাস নিতে হচ্ছে। আগামী অক্টোবরে আমি অবসরে (এলপিআর) যাবো। আমি চলে গেলে এই বিষয়গুলো কে দেখবে? শিক্ষার্থীদের এই মায়াজাল ছেড়ে যেতে পারবো কি না, তা নিয়েও আমি সন্দিহান।"
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূর মোহাম্মদ তার অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, "আমি একা কী করবো? শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে শিক্ষা বোর্ডে বহুবার জানিয়েছি, কিন্তু কোনো সমাধান মেলেনি। আমাদের ল্যাব আছে, সরঞ্জাম আছে, কিন্তু শিক্ষক নেই। বাইরে থেকে সামান্য সম্মানীতে একজন শিক্ষক রেখেছি, কিন্তু বিদ্যালয়ের ফান্ড না থাকায় ভালো শিক্ষক আনাও সম্ভব হচ্ছে না।"
এই পরিস্থিতিতে থানচির এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তার ৪০০ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ এক গভীর সংকটের মুখে পড়েছে। দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ না দিলে এই বিপর্যয় ঠেকানো অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সকলেই।
What's Your Reaction?






