ঘাস থেকে গুড় তৈরি করে অভাবকে জয় করে মিষ্টি গুড়ে ভাগ্য বদল খাদিজার

যেখানে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী আর ভবিষ্যৎ ছিল ধূসর, সেখানে এক টুকরো অবহেলিত ঘাসই হয়ে উঠল আশার আলো। অবিশ্বাস্য শোনালেও, ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার গৃহিণী খাদিজা বেগম সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখিয়েছেন। যেন এক জাদুকরের ছোঁয়ায় তিনি সাধারণ ঘাস থেকে তৈরি করছেন সোনারঙা মিষ্টি গুড়, যা কেবল রসনাকে তৃপ্ত করছে না, বদলে দিয়েছে তার পুরো জীবনের গল্প। একসময়ের অভাবী সংসারের এই নারী এখন মাসে আয় করছেন ৮০ হাজারেরও বেশি টাকা!
তিন সন্তানের মুখ আর স্বামীর সীমিত আয়ের দিকে তাকিয়ে খাদিজা বেগম হতাশ হননি, বরং খুঁজেছেন নতুন পথ। যখন তিনি স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে তার মাত্র ১০ শতক জমিতে ‘লিপিয়া’ (Lippia) ঘাস চাষ করে গুড় তৈরির কথা ভাবেন, তখন চারপাশের অনেকেই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিল। কিন্তু কোনো বিদ্রূপই তাকে দমাতে পারেনি। নিজের সংকল্পে অটুট থেকে তিনি একাই লড়াই চালিয়ে গেছেন।
নিজের সেই কঠিন সময়ের কথা মনে করে খাদিজা বেগম বলেন, “প্রথম দিকে অনেকেই আমার এই কাজকে পাগলামি ভেবেছিল, কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আমার বিশ্বাস ছিল, আমি পারবই। এখন আমার সাফল্য দেখে তারাই উৎসাহ পাচ্ছে। আমি চাই আমার মতো আরও অনেক নারী এভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াক এবং স্বাবলম্বী হোক।”
খাদিজা তার ১০ শতক জমিতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় চাষ করেন লিপিয়া ঘাস। সেই ঘাসের রস থেকে এক অভিনব কৌশলে তৈরি হয় গুড়। তার তৈরি এই গুড়ের সুনাম এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো এলাকায়। তিনি প্রতি কেজি গুড় ৪০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। শুধু গুড় নয়, ঘাসের আঁটিও বিক্রি হয় চড়া দামে। সব মিলিয়ে গুড় ও ঘাস বিক্রি করেই তার দৈনিক গড় আয় প্রায় ১৩০০ টাকা।
খাদিজার সাফল্যের গল্প শুধু ঘাসের গুড়েই সীমাবদ্ধ নেই। তার বাকি জমিতে এখন যেন এক ফলের রাজ্য। সেখানে শোভা পাচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির ফল—আপেল, পেঁপে, আঙুর থেকে শুরু করে মরুভূমির সৌদি খেজুর পর্যন্ত। এসব ফল ও সবজি বিক্রি করে তিনি প্রতিদিন আরও প্রায় ১৫০০ টাকা আয় করেন। সব মিলিয়ে তার মাসিক আয় এখন ৮০ হাজার টাকারও বেশি, যা দিয়ে তিনি সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালানোর পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন এক সুখের সংসার।
স্ত্রীর এই সাফল্যে গর্বিত স্বামী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, “আমি চাকরির পাশাপাশি ওকে যতটুকু পারি সাহায্য করি। ওর এই অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রমই আজ আমাদের সংসারে সুখ আর শান্তি এনে দিয়েছে। আমি ওর জন্য সত্যিই গর্বিত।”
খাদিজার তৈরি গুড়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ক্রেতারাও। আলমগীর কবির নামে এক নিয়মিত ক্রেতা বলেন, “খাদিজা আপার গুড় খুবই সুস্বাদু আর স্বাস্থ্যসম্মত। এর স্বাদ অন্য সব গুড়ের চেয়ে আলাদা, তাই আমি সব সময় এখান থেকেই কিনি।”
খাদিজার এই উদ্ভাবনী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে স্থানীয় কৃষি বিভাগও। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাহিদ আলী মীর বলেন, “ঘাস থেকে গুড় তৈরির বিষয়টি আমাদের কাছেও নতুন ছিল। কিন্তু খাদিজা বেগম তার পরিশ্রম ও একাগ্রতা দিয়ে এটি সফল করে দেখিয়েছেন। তিনি এখন অন্য নারীদের জন্য এক বড় অনুপ্রেরণা।”
আলফাডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তুষার সাহা জানান, “আমরা শুরু থেকেই খাদিজা বেগমকে কারিগরি সহায়তা দিয়ে আসছি। তার এই সাফল্য পুরো আলফাডাঙ্গার জন্য একটি গর্বের বিষয়।”
খাদিজা বেগম এখন শুধু একজন সফল উদ্যোক্তাই নন, তিনি বাংলাদেশের অগণিত গৃহিণীর কাছে এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তিনি প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছাশক্তি, পরিশ্রম আর উদ্ভাবনী চিন্তা থাকলে যেকোনো প্রতিকূলতাকেই জয় করা সম্ভব।
What's Your Reaction?






