থামছে না মধুমতীর ভাঙন, একটি স্থায়ী বাঁধের জন্য হাজারো মানুষের আকুতি

গভীর রাতে হঠাৎ বিকট এক শব্দ। ঘুম ভেঙে যায় নদীপাড়ের মানুষের। ঘর থেকে বেরিয়ে তারা যা দেখেন, তা শুধুই নিকষ কালো অন্ধকার আর প্রমত্তা মধুমতির সর্বগ্রাসী গর্জন। সকালের আলো ফুটতেই দেখা যায়, গতরাতের ভিটাটুকুও আর নেই, গিলে খেয়েছে রাক্ষুসে নদী।
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটিই এখন ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার মধুমতী তীরবর্তী গ্রামগুলোর নিত্যদিনের দুঃসহ বাস্তবতা। গত এক মাসে উপজেলার টগরবন্দ ইউনিয়নের টিটা পানাইল, শিকারপুর, ইকরাইল, টিটা, কোমরতিয়া এলাকায় বিলীন হয়েছে দেড় শতাধিক বসতবাড়ি, শত শত একর ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ভাঙনের তীব্রতায় ঘরবাড়ি হারিয়ে হাজারো মানুষ এখন নিঃস্ব। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন অন্যের জমিতে, কেউ বা রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নিচে। তাদের নির্ঘুম রাত কাটে এই আতঙ্কে—কখন আবার ছোবল দেবে সর্বনাশা মধুমতী!
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বুধবার (৩০ জুলাই) দুপুরে ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাসেল ইকবাল এবং ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে এম রায়হানুর রহমান, উপজেলা প্রকৌশলী মো. রাহাত ইসলামসহ জনপ্রতিনিধি, মিডিয়াকর্মী ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
ভাঙন কবলিত শিকারপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় শুধুই হাহাকার। ৮২ বছর বয়সী কৃষক জালাল মোল্লা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, "এই নদী আমার চোখের সামনে বাপ-দাদার ৪০ একর জমি কাইড়া নিছে। এলাকার স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ সব ভাঙনের মুখে। আমরা কই যাবো?"
রাস্তার ধারে অস্থায়ী এক ঝুপড়িতে বসে কথা বলছিলেন বিধবা মলিনা রানী বিশ্বাস। তার কথায় ঝরে পড়ছিল রাজ্যের ক্লান্তি আর হতাশা, "আমার বাড়ি ৪ বার ভাইঙা গেছে। ঘর, গাছপালা সব নদীতে। অহন রাস্তার পাশে পইড়া আছি। বলতে বলতে ক্লান্ত, আর বলার জায়গা নাই।"
গৃহবধূ হুসি বেগমের গল্পটাও একইরকম বেদনার। বিয়ের ১০ বছরেই ঘর ভেঙেছে ৫ বার। অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি বলেন, "আর কতবার ঘর সরাবো? সরকার যদি একটা স্থায়ী বাঁধ কইরা দিত, তাইলে হয়তো পোলাপান নিয়া একটু শান্তিতে বাঁচতে পারতাম।"
কয়েকজন ভুক্তভোগীরা জানান, ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে এই জনপদগুলো। তাদের সবার এখন একটাই দাবি, আর আশ্বাস নয়, চাই ভাঙন রোধে স্থায়ী সমাধান।
ওই ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য (৫ নম্বর ওয়ার্ড)মো. মুরাদ হোসেন বলেন, বর্ষার শুরু হতেই তাঁর ইউনিয়নে ভাঙন শুরু হয়। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না করলে নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে আরো বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলী জমিসহ নানা প্রতিষ্ঠান।সরকারের কাছে স্থায়ী বাধের দাবি জানান তিনি।
ওই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইমাম হাসান শিপন জানান, মধুমতী নদীর ভাঙ্গনে অসংখ্য বসতবাড়ি, আবাদি জমি, স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ নদীতে বিলিন হয়েছে। তিনি জানান, কয়েক বছর আগে এখানে যে ভোটার ছিল। এখন আর তা নেই। ভাঙ্গনের রোধে সরকারের পক্ষ থেকে যদি কোন ধরনের পদক্ষেপ না নেয়া হয়, কয়েক বছরের মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে পুরো গ্রাম-জনপদ। তিনি ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সন্তোষ কর্মকার জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ খুব শীঘ্রই এলাকা পরিদর্শনে আসবেন এবং এরপরই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ভাঙন এলাকা পরিদর্শন শেষে ইউএনও রাসেল ইকবাল বলেন, "ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে এবং নদীভাঙন রোধে জরুরি ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অনুরোধ করা হয়েছে।"
তবে প্রশাসনের আশ্বাসে পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারছেন না নদীপাড়ের মানুষ। তাদের সবার এখন একটাই আকুতি, আর যেন একটি বাড়িও কেড়ে নিতে না পারে মধুমতী। তাদের চোখের সামনে বিলীন হওয়ার আগেই যেন শুরু হয় স্থায়ী বাঁধের কাজ।
What's Your Reaction?






