থানচিতে নেটওয়ার্ক বিপর্যয়: জরুরি সেবা বন্ধ, বিপাকে হাজারো মানুষ

আধুনিক বিশ্ব থেকে যেন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। না আছে মোবাইলের রিংটোন, না আছে ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের সুযোগ। গত দুই মাস ধরে এমনই এক ডিজিটাল নির্বাসনে রয়েছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের থানচি উপজেলা। মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট সেবার ভয়াবহ বিপর্যয়ে এখানকার হাজার হাজার মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে, ভোগান্তি পৌঁছেছে চরমে।
সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের দৈনন্দিন কাজকর্মে নেমে এসেছে স্থবিরতা, প্রবাসে থাকা প্রিয়জনের সাথে কথা বলা বন্ধ, মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে এবং অনলাইন-ভিত্তিক জরুরি সেবাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এক প্রকার বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে পুরো উপজেলা।
একসময় সেবার মানে এগিয়ে থাকা রবি ও এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক গত দুই মাস ধরে প্রায় অচল। সরকারি টেলিটকের অবস্থাও তথৈবচ—বিদ্যুৎ চলে গেলেই বন্ধ হয়ে যায় টাওয়ার। স্থানীয়দের অভিযোগ, টাওয়ারগুলোতে নিয়মিত তদারকি নেই, নেই জেনারেটরের জন্য জ্বালানি বা সোলার প্যানেলের ব্যবস্থা।
কিন্তু এর পেছনের কারণ আরও গভীর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টাওয়ার-সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি জানান, আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর চাঁদা দাবি এবং বেপরোয়া তৎপরতার কারণেই মূলত নিরাপত্তাঝুঁকিতে রয়েছেন কর্মীরা। এর পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানের কারণেও নেটওয়ার্ক স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া রবির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে বিল সংক্রান্ত জটিলতাও এই অচলাবস্থার অন্যতম কারণ।
তবে, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো এসব কারণ এড়িয়ে যাচ্ছে। রবি ও এয়ারটেলের প্রতিনিধিরা সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বান্দরবানের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি কবির খান বলেন, "বর্ষার বাতাসে বিজিবি ক্যাম্পের টাওয়ার নড়বড়ে হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার অসুস্থ থাকায় মেরামত করতে দেরি হচ্ছে।" টেলিটকের প্রতিনিধি জামাল উদ্দিন জানান, যান্ত্রিক ত্রুটির কথা গত দুই মাস ধরে জানালেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
এই অচলাবস্থার সবচেয়ে বড় শিকার সাধারণ মানুষ। সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান চসাথোয়াই মারমা জানান, "নেটওয়ার্ক না থাকায় আমাদের মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ। আমরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।"
থানচি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যোহন ত্রিপুরা বলেন, "আধুনিক যুগে নেটওয়ার্ক ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না। জরুরি প্রয়োজনে কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। অফিসিয়াল এবং ব্যক্তিগত সব কাজকর্মে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে পারে না।"
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-ফয়সাল নিজেও নেটওয়ার্কের ধীরগতির কথা স্বীকার করে বলেন, "আমি বিষয়টি অনুভব করছি। শিগগিরই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই জনপদের হাজারো মানুষ এখন তাকিয়ে আছে প্রশাসনের দিকে—কবে ফিরবে নেটওয়ার্ক, কবে ভাঙবে এই অচলাবস্থা?
What's Your Reaction?






