বংশ নয়, কর্মে অমর - আলফাডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী খান বাহাদুর পরিবার

কবির হোসেন, আলফাডাঙ্গা প্রতিনিধি, ফরিদপুরঃ
Jul 3, 2025 - 15:06
 0  9
বংশ নয়, কর্মে অমর - আলফাডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী খান বাহাদুর পরিবার

ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড—এই চার স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আছে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার বুড়াইচ এলাকার ‘খান বাহাদুর জমিদার বাড়ি’। শত বছরের প্রাচীন এই স্থাপনাটি শুধু স্থাপত্যেই নয়, বংশধরদের কর্মগৌরবেও সমুজ্জ্বল। পল্লী সমাজের মাঝে আলো ছড়ানো এই জমিদার পরিবার আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের নানামুখী অবদানের জন্য।

প্রায় ২০০ শতাংশ জমির উপর স্থাপিত এই ঐতিহাসিক বাড়িটি এলাকাবাসীর কাছে ‘বুড়াইচ মৌলভি বাড়ি’ নামেই পরিচিত। অনেকটা সময় অবহেলায় পড়ে থাকলেও সম্প্রতি এই প্রাসাদতুল্য স্থাপনাটি সংস্কারের মাধ্যমে ফিরে পেয়েছে তার হারানো গৌরব। বিশেষত খান বাহাদুর পরিবারের ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি নতুন রূপে নির্মিত হওয়ায় বাড়িটি পেয়েছে নতুন মাত্রা।

এ মসজিদ ও জমিদার বাড়ির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পরিদর্শনে আসেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন ও তাঁর সহধর্মিণী মিস তেরেসা আলবার্ট। তাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন খান বাহাদুর পরিবারের সদস্য স্থপতি প্রকৌশলী মেরিনা তাবাচ্ছুম, ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইয়াছিন কবির, উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম জাহিদুল হাসান জাহিদ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল হক, সহকারী পুলিশ সুপার (মধুখালী সার্কেল) সুমন কর এবং স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা।

এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি বিশিষ্ট নাট্যকার মোঃ নুরুল মোমেন এবং তাঁর বংশধরদের জন্মভিটা। তাঁর পিতা মৌলভি নুরুল আরেফিন ছিলেন একজন ধর্মভীরু ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। নাট্যকার নুরুল মোমেন তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে পেয়েছেন কলকাতা সংবর্ধনা (১৯৫৪), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬১), শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নাট্য সংস্থার সংবর্ধনা (১৯৬৪), ব্রিটিশ থিয়েটার ব্যক্তিত্বদের স্বীকৃতি (১৯৬৬), বাংলাদেশ থিয়েটার কর্তৃক সংবর্ধনা (১৯৭৭) এবং একুশে পদক (১৯৭৮)।

তাঁর অন্যান্য ভাইয়েরাও ছিলেন কৃতী ব্যক্তিত্ব—লে. কর্নেল ডা. নুরুল আমিন (ব্রিটিশ আর্মির চিকিৎসক), ডা. নুরুল আহাদ (বার্মার সিভিল সার্জন), ডা. নুরুল ওহাব (সাব-রেজিস্ট্রার ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক)।

এই পরিবারের আরেক শ্রেষ্ঠ সন্তান ছিলেন খান বাহাদুর আসাদ উজ জামান। ১৮৭৭ সালে কলকাতায় জন্ম নেওয়া এ মানুষটি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা ও কলকাতায়। ১৮৯৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে মুসলিম সমাজে আলোড়ন তুলেছিলেন। তিনি পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৮৯৯ সালে আইন সনদ লাভ করেন।

পিরোজপুর মহকুমা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে তিনি সমাজসেবা ও জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজ করে ইংরেজ সরকার কর্তৃক “খান বাহাদুর” উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে কবি নজরুল ইসলামের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন, যেখানে কবিকে দেওয়া হয় সোনার দোয়াত-কলম ও রুপার ক্যাসকেট।

সমবায় আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি। পরবর্তীতে আইন ব্যবসায় যুক্ত হয়ে নিজ এলাকা আলফাডাঙ্গায় এ. জেড. পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, আসাদুজ্জামান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, বুড়াইচ প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বুড়াইচ সামসুল হক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

আলফাডাঙ্গা আসাদুজ্জামান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন,

“নারী শিক্ষার প্রসারে খান বাহাদুর পরিবার যে অবদান রেখেছে, তা চিরস্মরণীয়। পাশাপাশি বালকদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘আলফাডাঙ্গা আরিফুজ্জামান উচ্চ বিদ্যালয়’ বর্তমানে একটি সরকারি বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।”

বর্তমানে জমিদার বাড়িটিতে পরিবারের কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করেন না। দুইজন কেয়ারটেকার—সাগর ও নাজমুল—এটি দেখাশোনা করেন। কেয়ারটেকার সাগর বলেন,

“এই পরিবারের মানুষগুলো অত্যন্ত ভালো। ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষায় তাঁদের অবদান মানুষ চিরকাল মনে রাখবে।”

উল্লেখ্য, খান বাহাদুর ওহিদুন নবী, মোঃ নুরুল আমিন, খান বাহাদুর আসাদুজ্জামান ও আহামেদুজ্জামান পরস্পর চাচাতো ভাই। এই বংশধররাই গড়ে তুলেছেন আজকের এই জনসেবামূলক ঐতিহ্য।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow