বর্ষায় ভাসে জীবিকা, টিকে থাকে ঐতিহ্য — সালথার কাঠের নৌকা শিল্পে প্রাণচাঞ্চল্য

বর্ষা মানেই বৃষ্টি, খাল-বিল-নদীতে টলমলে পানি আর গ্রামবাংলার এক চিরচেনা দৃশ্য— কাঠের নৌকা। এই ঐতিহ্যবাহী বাহন শুধু যাতায়াতের উপায় নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা বহু মানুষের জীবিকার সাথে জড়িয়ে আছে। ফরিদপুরের সালথা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এখন চলছে কাঠের নৌকা তৈরির মৌসুমি ব্যস্ততা, যা যেন জীবিকার এক উৎসব হয়ে উঠেছে।
সালথার মোন্তার মোড়, সাড়ুকদিয়া, নকুলহাটি ও মাঝারদিয়া গ্রাম— প্রতিটিই যেন একটি ক্ষুদ্র নৌকা শিল্পপল্লীতে রূপ নিয়েছে। সেখানে এখন চোখে পড়ে কাঠের গুঁড়ি সাজানো, করাতের ঘর্ঘর শব্দ, হাতুড়ির ঠোকাঠুকি আর রঙ-তুলির ছোঁয়ায় ব্যস্ত শ্রমিকদের দৃশ্য।
নকুলহাটি বাজারসংলগ্ন একটি নৌকা কারখানায় দেখা মিলল কারিগর মো. রবিউল ইসলামের। তিনি দুই দশক ধরে এই পেশায় যুক্ত। তিনি বলেন, “বর্ষা আসার দেড়-দুই মাস আগেই আমাদের ব্যস্ততা শুরু হয়। এখন অর্ডারের চাপ এত বেশি যে খাওয়ার সময়ও ঠিকমতো পাই না।"
তিনি জানান, একটি মাঝারি আকারের নৌকা বানাতে সময় লাগে তিন থেকে চার দিন। কাঠ, রঙ, হাতুড়ি, করাত— সবকিছু নিয়েই চলে এদের নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম। প্রতিটি মৌসুমে তারা ৫০ থেকে ৭০টি নৌকা তৈরি করে থাকেন।
একই কারখানার তরুণ কারিগর শাহীন শেখ বলেন, “জীবনযাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও গ্রামাঞ্চলে কাঠের নৌকার কদর এখনো অটুট। কৃষক, জেলে, এমনকি দোকানদাররাও বর্ষায় খাল-বিল কিংবা জমা পানিতে যাতায়াতের জন্য কাঠের নৌকা ব্যবহার করেন।”
সালথার এসব এলাকায় বৈচিত্র্যময় আকার ও দামে কাঠের নৌকা পাওয়া যায়। ছোট আকারের নৌকার দাম পড়ে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা, আর বড় আকারের ও রঙিন নৌকার দাম ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। কাঠের মান ও কারিগরি দক্ষতার ওপর দাম নির্ভর করে।
ব্যবসায়ী আবদুল হালিম জানান, “অনেকে এখন টিন বা ফাইবারের নৌকার দিকে ঝুঁকছেন, তবে ভারসাম্য, টেকসই ব্যবহার ও সংস্কারের সুবিধার জন্য কাঠের নৌকার চাহিদা এখনও বেশি।”
এই নৌকা শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি বিস্তৃত কর্মচক্র— কাঠ সরবরাহকারী, করাতকল, রংমিস্ত্রি, বাহক, এমনকি স্থানীয় দোকানগুলো পর্যন্ত উপকৃত হচ্ছে এ মৌসুমি শিল্পচক্র থেকে। কারখানা মালিক মো. ফিরোজ মোল্লা বলেন, “বর্ষা আমাদের জন্য ঈদের মতো। এই সময়ের রোজগার দিয়েই অনেক পরিবার সারা বছরের খরচ চালায়।”
স্থানীয় প্রবীণ শিক্ষক আবদুল কাদের বলেন, “নৌকা শুধু বাহন নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশ। একসময় বিয়ে বা গ্রামীণ উৎসবে নৌকা ছিল অপরিহার্য। আজও অনেক এলাকায় সেই ঐতিহ্য টিকে আছে।”
প্রসঙ্গত, সালথার মতো অঞ্চলে কাঠের নৌকা তৈরি কেবল মৌসুমি ব্যবসা নয়, এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্য। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে দরকার সরকারের সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ। প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ এবং বাজারজাতকরণে সহায়তা পেলে একে ঘিরে তৈরি হতে পারে একটি শক্তিশালী গ্রামীণ অর্থনৈতিক ভিত্তি।
What's Your Reaction?






