কুবির পথচলার গল্প: শুরু থেকে আজ
লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের সবুজে ঘেরা নিসর্গের বুক চিরে জন্ম নেওয়া এক সম্ভাবনার নাম—কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৬ সালের ২৮ মে যাত্রা শুরু করা এই বিশ্ববিদ্যালয় আজ ২০ বছরে পদার্পণ করেছে। যাত্রা শুরু হয়েছিল হাতে গোনা কয়েকটি ভবন, মাত্র ৭টি বিভাগ, ৩০০ শিক্ষার্থী ও ১৫ জন শিক্ষকের সমন্বয়ে। এখন কুবি শুধুই একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্নপূরণের স্থান, গবেষণার ক্ষেত্র এবং নেতৃত্বের প্রশিক্ষণভূমি।
শুরুর দিনগুলো: সীমাবদ্ধতার অধ্যায়
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের কুবি ছিল সীমিত সুযোগ-সুবিধা ও পরিকাঠামোগত সংকটের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। শিক্ষক সংকট, পর্যাপ্ত ক্লাসরুমের অভাব, লাইব্রেরির সীমিত পরিসর, ডিজিটাল সুযোগের অভাব—সবমিলিয়ে শুরুটা ছিল অনেকটা সংগ্রামের। প্রযুক্তিনির্ভর শ্রেণিকক্ষ বা সফট স্কিল প্রশিক্ষণ তো দূরের কথা, শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থাও ছিল না।
ধাপে ধাপে উন্নয়নের গল্প:
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আজ ডিজিটাল ক্লাসরুম, আধুনিক গবেষণাগার, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, সেমিনার কক্ষ এবং কেন্দ্রীয় ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কসহ এক নতুন অবকাঠামোর দিকে ধাবমান। বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বিভাগ সংখ্যায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি ঘটেছে। কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা জাতীয় পর্যায়ে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় কৃতিত্ব অর্জন করছে, অনেকেই কাজ করছেন Microsoft-এর মতো বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাও বদলে গেছে। আগের ট্র্যাডিশনাল পাঠ্যক্রমের পরিবর্তে এখন Outcome Based Education (OBE) চালু হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী দক্ষতায় প্রস্তুত করা হচ্ছে। AI ও টেকনোলজির সহায়তায় শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করছে নানান এডুকেশনাল টুলস, যা তাদের শেখার প্রক্রিয়াকে করেছে আরও গতিশীল।
উদ্ভাবন ও গবেষণা:
এখন কুবির শিক্ষার্থীরা শুধু সিলেবাসভিত্তিক শিক্ষায় নয়, গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমেও সমান পারদর্শী। এর প্রমাণ রোবট 'সিনা' ও 'ব্লুবেরি'। কথা বলা ও চলাফেরা করতে সক্ষম রোবট ‘সিনা’ তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বার্ডের সহায়তায়। অন্যদিকে, ‘কোয়ান্টা রোবটিক্স’ টিমের ব্লুবেরি রোবট তৈরি হয়েছে নেকটার-এর অর্থায়নে। এই উদ্ভাবনগুলো কুবির ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি শিক্ষার দিগন্তকে প্রসারিত করেছে।
আগামীর স্বপ্নময় ২০০ একরের সম্প্রসারিত ক্যাম্পাস:
বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারণ প্রকল্প এখন কেবল উন্নয়ন নয়, এক স্বপ্নপূরণ। রাজারখোলায় অধিগ্রহণ করা প্রায় ২০০ একর জমিতে গড়ে উঠছে ৪টি ১০তলা একাডেমিক ভবন, ৬ তলা প্রশাসনিক ভবন, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ৪টি ১০ তলা আবাসিক হল, শিক্ষক-কর্মচারী আবাসন, আন্তর্জাতিক মানের মেডিকেল, কেন্দ্রীয় মসজিদ, টিএসসি, মিলনায়তন, ক্রীড়া কমপ্লেক্স ইত্যাদি।
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই প্রকল্পের প্রায় ৬৮.৮৬% কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং ২০২৬ সালের জুন নাগাদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
কুবির গ্র্যাজুয়েটরা আজ কোথায়?
কুবির সাবেক শিক্ষার্থীরা আজ কাজ করছেন দেশের শীর্ষ প্রশাসন, ব্যাংক, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এমনকি বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। তাদের হাত ধরে কুবির নাম পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বদরবারে।
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রভাষক মোঃ জাহিদুর রহমান বলেন- ‘‘একজন কুবিয়ান হিসেবে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা আমার জন্য গর্বের। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যদি বলি, আমাদের কারিকুলাম বিশ্বমানের। কুবিয়ানরা দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভালো করার পাশাপাশি দেশের বাইরে উচ্চ র্যাংকিং এর বিশ্ববিদ্যালয়ে সফলতার সাথে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত সম্পদের অসীম ব্যবহার হচ্ছে। CSE বিভাগের কথাই যদি বলি, আমাদের শিক্ষার্থীরা জাতীয় পর্যায়ে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা খুব ভালো করছে। Microsoft এর মত প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার একটি পরিবর্তন হল, এখন আমরা Outcome Based Education (OBE) কারিকুলাম অনুসরণ করছি। শিক্ষার্থীদের Outcome বেসড যুগোপযোগী শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যেই এই কারিকুলাম করা হয়েছে। আরো উল্লেখ্য, এখনকার সময়ে AI এর কল্যানে শিক্ষার্থীরা অনেক শিক্ষা সহকারী টুলস পাচ্ছে, যা আমাদের সময়ে ছিল না। ভবিষ্যতে আশা থাকবে, শিক্ষার্থীরা যেন OBE কারিকুলাম এর সাথে মানিয়ে নিয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনী কাজে অধিকতর অবদান রাখতে পারে।“
ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তারিন বিনতে ইনাম বলেন- “একজন সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমান শিক্ষক হিসেবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এবং এগিয়ে চলার পথচলা কাছ থেকে দেখেছি। আমাদের সময় শিক্ষক স্বল্পতা, ক্লাস সংকট ছিলো। প্রযুক্তির আধুনিক ব্যবহার তখন ছিলো না। লাইব্রেরি, ট্রান্সপোর্ট সুবিধাও বলত গেলে ছিলো না। সে হিসেবে বিগত বছরগুলোতে শিক্ষক সংকট অনেকটাই কেটেছে, প্রযুক্তিনির্ভর ক্লাসরুম হয়েছে, লাইব্রেরি সমৃদ্ধ হয়েছে। শিক্ষক এবং গ্র্যাজুয়েটদের উচ্চ শিক্ষায় গমন, গবেষণার হার অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা এখন অনেক বেশি মত প্রকাশ করতে পারে, আর কুবির শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই এই জায়গাটায় ভোকাল। এই অবকাঠামোগত অগ্রগতি শুধু দৃষ্টিনন্দন নয়, শিক্ষার মান উন্নয়নেও সহায়ক হয়েছে। শিক্ষার মানেও এসেছে গুণগত পরিবর্তন। দক্ষ ও প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষকরা এখন নিয়মিত আন্তর্জাতিক মানের পাঠদান ও গবেষণা করছেন। শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন অলিম্পিয়াড, প্রতিযোগিতা ও প্রকাশ করছেন গবেষণাপত্র-দেশ-বিদেশে। আমাদের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এখন কর্মরত আছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রশাসন, ব্যাংকিং, প্রযুক্তি, শিক্ষা ও গবেষণা খাতে। অনেকে আবার উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়ন করছেন, বিশ্বজুড়ে তুলে ধরছেন কুবির নাম। যদি আমরা তাদের গবেষণায় নিয়মিতভাবে সম্পৃক্ত করতে পারি, তবে জ্ঞানের ক্ষেত্র আরও সমৃদ্ধ হবে।
What's Your Reaction?






